বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তঘেঁষা শার্শা উপজেলার শালকোনা গ্রাম প্রকৃতির অপূর্ব লীলাভূমি। বিশেষ করে বর্ষার দিনে এই জনপদ যেন রূপকথার আবহে ভরে ওঠে। চারদিকের সবুজ প্রকৃতি, জলে ভরা খাল-বিল, কালো মেঘে ঢাকা আকাশ আর টিনের চালের ওপর টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ—সব মিলিয়ে শালকোনা হয়ে ওঠে এক অনন্য কবিতার ক্যানভাস।
শালকোনা গ্রামটি যশোর জেলার শার্শা উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত। চারপাশজুড়ে বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত, ছোট বড় খাল-বিল আর মাটির রাস্তার সারি। শহরের কোলাহল থেকে অনেকটা দূরে হলেও এই গ্রামটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে বিশেষভাবে পরিচিত।
বর্ষার আগমনেই এ জনপদে এক ভিন্ন আবহ তৈরি হয়। শুকনো মৌসুমের ধুলোমাখা কাঁচা পথ ও পানিশূন্য খাল-বিলগুলো হঠাৎ করেই ভরে ওঠে প্রাণের স্রোতে। এ যেন প্রকৃতির এক নবজাগরণের ঋতু।
বর্ষা এলে শালকোনার প্রকৃতি নতুন রূপে সেজে ওঠে। চারপাশের ধানক্ষেতের সবুজ পাতা, জলে ভরা ডোবা-গর্ত, খাল-বিলের টলমলে জল গ্রামের দৃশ্যপটকে করে তোলে স্বপ্নীল।
রোপা আমনের চারাগুলো যখন পানিতে ডুবে থাকে, তখন মনে হয়, তারা জলের বুক চিরে জীবনের গান গাইছে। বৃষ্টিভেজা গাছপালা ও শ্যাওলা ঢাকা পুকুরপাড় এই গ্রামকে দেয় এক অনন্য নান্দনিকতা।
শালকোনার মানুষের কাছে বর্ষা মানে শুধু কষ্ট নয়, আনন্দও বটে। বৃষ্টি নামলেই গ্রামের শিশুরা ছুটে যায় মাঠে, কেউ নৌকা ভাসায়, কেউ আবার বৃষ্টির জলে খেলায় মেতে ওঠে।
গ্রামের প্রবীণ মানুষরা বসে থাকে উঠোনে কিংবা টিনের চালের নিচে। টুপটাপ বৃষ্টির সুরে তারা ডুবে যায় অতীতের স্মৃতিতে, কখনও আড্ডা দেয়, আবার কখনও গল্পে মশগুল হয়।
একসময় যশোরের গ্রামগুলোতে নৌকা ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী। তালগাছের ডোঙ্গা ও কাঠের নৌকা ছাড়া বর্ষায় চলাফেরা প্রায় অসম্ভব ছিল। আধুনিকতার কারণে সেসব দৃশ্য অনেকটা হারিয়ে গেলেও বর্ষার ভরা জলে সেই স্মৃতি আবার ফিরে আসে।
শালকোনার তরুণরা এখনো নৌকা ভাসিয়ে আনন্দ খুঁজে নেয়। নৌকাবাইচ, খালের জলে খেলাধুলা গ্রামীণ জীবনের রঙকে আরও বর্ণময় করে তোলে।
যদিও বর্ষা গ্রামে আনে অপরূপ সৌন্দর্য, তবুও এটি কিছুটা ভোগান্তিরও কারণ। কাঁচা রাস্তা কাদা-পানিতে ভরে ওঠে, যাতায়াত হয় কষ্টকর। কৃষকদের জমির কাজে বাধা আসে, কখনও কখনও অতিবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
তবে এসব কষ্ট সত্ত্বেও শালকোনার মানুষ বর্ষাকে আপন করে নেয়। তাদের কাছে এটি শুধু জল নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অটুট সম্পর্কের প্রতীক।
শালকোনার গ্রামীণ সমাজে বর্ষার একটি আলাদা সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হয়। বৃষ্টির দিনে উঠোনে বসে গল্পগুজব, লোকগীতি গাওয়া, বাঁশির সুর কিংবা কেবল বৃষ্টির শব্দে ডুবে থাকা—সবকিছুই যেন মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
এ ছাড়া গ্রামে ঐতিহ্যবাহী খেলা, আঞ্চলিক গান, বর্ষা কবিতা পাঠ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গ্রামীণ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে আসছে।

চারদিকের জলমগ্ন মাঠ, মেঘে ঢাকা আকাশ, শাপলা ভরা পুকুর, ভেজা গাছের ডালপালা—সবকিছু মিলিয়ে মনে হয় প্রকৃতি যেন নিজেই সাজিয়েছে এক কাব্যিক মঞ্চ।
বৃষ্টির দিনে শালকোনা হয়ে ওঠে এক জলরঙে আঁকা কবিতার মতো ছবি। এই সৌন্দর্য কেবল চোখে ধরা দেয় না, হৃদয়কেও ছুঁয়ে যায়।
শালকোনার মানুষের কাছে বর্ষা মানে জীবনের নতুন সুর। এটি শুধু একটি ঋতু নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চিরন্তন বন্ধনের প্রতীক।
বর্ষা শেখায় কষ্টের মাঝেও আনন্দ খুঁজে নিতে, প্রকৃতির সঙ্গী হয়ে বেঁচে থাকতে। তাই সীমান্তের এই ছোট্ট গ্রামটি বর্ষার দিনে হয়ে ওঠে এক অনন্য জীবনের গান।
যশোরের শার্শা উপজেলার সীমান্তঘেঁষা শালকোনা গ্রাম আমাদের শেখায় যে, গ্রামের জীবনযাত্রা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। বর্ষার দিনে এই জনপদ এক কবিতার আবহ তৈরি করে, যেখানে আনন্দ ও কষ্ট পাশাপাশি চলে।
বাংলার এই গ্রাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বাংলাদেশ কেবল ভৌগোলিক মানচিত্রের একটি স্থান নয়, বরং মানুষের আবেগ, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সম্মিলিত সুর।
✍️ তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ২০ আগস্ট ২০২৫