বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ নামটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তিনি লড়াই করেছেন সত্যের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং সমাজকে আলোকিত করার জন্য। দীর্ঘ অসুস্থতার পর অবশেষে তিনি বিদায় নিয়েছেন পৃথিবীর মায়া থেকে, কিন্তু রেখে গেছেন সাহস, সততা ও মানবিকতার অমূল্য উত্তরাধিকার।
গত কয়েক মাস ধরে রুকুনউদ্দৌলাহ অসুস্থতায় ভুগছিলেন। ১৯ আগস্ট রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে তাঁর হৃদযন্ত্রে তিনটি রিং স্থাপন করা হয়। চিকিৎসকরা আশার আলো দেখালেও শারীরিক অবস্থার উন্নতি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। চিকিৎসা শেষে তিনি যশোরে ফিরে আসেন, যেখানে বন্ধু, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে ঘিরে রাখেন।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দ্রুত তাঁকে যশোর জেনারেল হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয়। সর্বশেষ ৭টা ৪০ মিনিটে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রুকুনউদ্দৌলাহ শুধু মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না; তিনি ছিলেন সাংবাদিকতার জগতে সাহসী এক কলমযোদ্ধা। স্বাধীন মতপ্রকাশে তিনি ছিলেন আপসহীন। সমাজের অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর লেখা সবসময়ই ছিল দৃঢ় ও স্পষ্টভাষী। যশোরের সাংবাদিক সমাজে তিনি ছিলেন এক অবলম্বন—প্রেরণার নাম।
তাঁর লেখা প্রতিবেদনে ফুটে উঠত মুক্তচিন্তার শক্তি, সত্যের নির্ভীক প্রকাশ এবং মানবতার পক্ষে অবস্থান। ফলে সাংবাদিক সমাজে তাঁর অবদান কেবল একটি প্রজন্মকেই নয়, আগত প্রজন্মকেও অনুপ্রেরণা জোগাবে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন, তা আজও অনুকরণীয়। স্বাধীনতার মূল্য, দেশপ্রেম আর মানবিকতার আদর্শ তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধারণ করেছিলেন। তাঁর কাছে সাংবাদিকতা মানেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক নিরলস প্রয়াস।
রুকুনউদ্দৌলাহকে যাঁরা কাছ থেকে চিনতেন, তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন সহজ-সরল অথচ দৃঢ়চেতা এক মানুষ। মাত্র কয়েকদিন আগেই, ৫ আগস্ট, অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি সহকর্মীর অফিসে গিয়েছিলেন। কেউ ভাবতেও পারেননি সেটিই হবে তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা। তাঁর হাসি, আন্তরিকতা আর কথা বলার ভঙ্গি আজও হৃদয়ে অনুরণিত হয়।
যশোরের সাংবাদিক সমাজ তাঁকে চিরকাল মনে রাখবে। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে সত্যকে তুলে ধরতে হয়, কীভাবে নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে হয় এবং কিভাবে সমাজ পরিবর্তনে কলম হতে পারে সবচেয়ে বড় শক্তি।
তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূরণ হবে না। তবে তাঁর লড়াই, সততা, সাহস এবং মানবিকতা আমাদের জন্য চিরন্তন প্রেরণা হয়ে থাকবে। তিনি দেখিয়ে গেছেন, একজন সত্যিকারের সাংবাদিক কেবল সংবাদ লেখেন না—তিনি সমাজকে আলোকিত করেন, মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন এবং ন্যায়ের পথে দাঁড়ান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহর মৃত্যু কেবল একটি পরিবারের নয়, গোটা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের শিক্ষা দেয়—সত্য, সাহস আর মানবিকতা দিয়েই সমাজকে এগিয়ে নিতে হয়। তিনি ওপারে ভালো থাকুন, আর আমরা তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারকে বহন করে এগিয়ে যাই।