যশোরের কবি আজীজুল হক : মানুষের হৃদয়ে অম্লান এক আলোকপুরুষ

যশোরের কবি আজীজুল হক মানুষের হৃদয়ে অম্লান এক আলোকপুরুষ। কবিতা, প্রবন্ধ ও সাংস্কৃতিক অবদানে তিনি আজও অনন্য।

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভুবনে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা কেবল সৃজনশীলতার জন্যই নয়, বরং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেও অনন্য হয়ে উঠেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি আজীজুল হক। যশোরের মানুষের মনে তিনি শুধু একজন কবি নন, বরং এক আলোকপুরুষ, যিনি আজও স্মৃতির ভাঁজে অমলিন হয়ে আছেন।

১৯৩০ সালের ২ মার্চ মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার তারাউজাল গ্রামে জন্ম নেন আজীজুল হক। শৈশবেই পড়াশোনার প্রতি তাঁর অনুরাগ তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যায়। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি শ্রীপুর মহেশচন্দ্র উচ্চ ইংরেজি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। এরপর বাগেরহাট পি.সি. কলেজ থেকে আইএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

শিক্ষাজীবন শেষে তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়ে পরের বছর যশোরের মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে দায়িত্ব নেন। সেখানেই তিন দশক ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সাহিত্যের আলোয় আলোকিত করেন এবং ১৯৮৮ সালে অবসরে যান।

আজীজুল হক ছিলেন মননশীল এক কবি, যার কবিতায় ফুটে উঠেছে মানবপ্রেম, সমাজচেতনা ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ববোধ। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখা বিখ্যাত কবিতা কৃষ্ণচূড়ার তৃষ্ণা” সমাজের অস্থিরতা ও মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝিনুক মুহূর্ত সূর্যকে”, যা পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় বিনষ্টের চিৎকার” (১৯৭৬), ঘুম সোনালী ঈগল” (১৯৮৯) এবং আজীজুল হকের কবিতা” (১৯৯৪)। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থই তাঁর সাহিত্যিক পরিচয়কে আরও দৃঢ় করে।

ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসনের ভয়াবহ দমননীতির সময় তিনি লেখনীকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে তাঁর সাহসী কবিতা ও প্রবন্ধ ছিল প্রেরণার উৎস। একই সঙ্গে যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও তিনি সমৃদ্ধ করেন।

ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবস—যশোরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। তাঁর দৃঢ় উচ্চারণ, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য এবং শিল্পিত ভঙ্গি মানুষের হৃদয় জয় করত সহজেই।

যশোরের কারবালা কবরস্থানে তাঁর কবরে খোদাই করা আছে একটি লাইন—মেঘমুখী ফুল তুমি সূর্যমুখী হও। সূর্যই আমাদের প্রথম নায়ক।”

এই কথাগুলোই তাঁর জীবনবোধের প্রতীক। জীবনে তিনি সবসময় আলোর পথে, সত্যের পথে এবং মানবিকতার পথে চলতে শিখিয়েছেন।

বাংলা একাডেমি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁকে সম্মাননা দিয়েছে। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিল সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। যশোরের সংস্কৃতি ও সাহিত্য অঙ্গনে আজও তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

২০০১ সালের এই দিনে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তিনি শুধু একজন কবি বা প্রাবন্ধিক হিসেবেই নয়, বরং একজন শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং মানবিক মানুষ হিসেবেও চিরদিন বেঁচে আছেন।

যশোরের রাস্তায় তাঁর ঋজু ভঙ্গিতে হাঁটা, মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা আর অনন্য ব্যক্তিত্ব আজও মনে করিয়ে দেয়—তিনি ছিলেন শহরের প্রাণ।

আজীজুল হক তাই চিরকাল থাকবেন মানুষের হৃদয়ে—বাংলা কবিতা ও সংস্কৃতির আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে।

লেটেস্ট আপডেট...

আইপিএল স্পেশাল...

যশোর ক্রীড়া সংস্থায় কাজী এনামের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে উত্তেজনা: ঘেরাও, স্মারকলিপি ও প্রতিবাদের ঝড়

যশোর ক্রীড়া সংস্থার এডহক কমিটিতে বিসিবির সাবেক পরিচালক কাজী এনাম আহমেদকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত ঘিরে স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক, খেলোয়াড় ও ক্রীড়াপ্রেমীদের মধ্যে...

সেলিব্রেটি গসিপ...

মেগান মার্কেলের উদ্বেগ: প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে রাজা চার্লসের মিলন ঘিরে নতুন বিতর্ক

প্রিন্স হ্যারি এ সপ্তাহে লন্ডনে ফিরেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি যোগ দিচ্ছেন WellChild Awards-এ, তবে আড়ালে আলোচনার বিষয় হচ্ছে—তিনি কি তাঁর দূরত্ব তৈরি হওয়া বাবা, রাজা...

সম্পর্কিত আরও পড়ুন...

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Translate »