বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি অনিবার্য চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটিতা, জীববৈচিত্র্যের হুমকি এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা—সবই মানবজীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই সম্প্রতি ঢাকায় এক অনন্য জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা বৈশ্বিক ঐক্য, স্থানীয় নেতৃত্ব এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলেছে।
সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের উদ্যোগে এবং ক্লাইমেট অ্যাকশন অ্যাট লোকাল লেভেল (CALL) কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকার একটি কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত হয় “বায়োফিলিয়া: মানুষ, জলবায়ু ও সংস্কৃতির পুনঃসংযোগ” শীর্ষক অনুষ্ঠান। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে জলবায়ু সুরক্ষায় একত্রিত করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই বিশ্ব গড়ে তোলার শপথ নেওয়া।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তৃতায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জোর দিয়ে বলেন,
“জলবায়ু সংকট কেবল টিকে থাকার প্রশ্ন নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা ও বহু রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথেও জড়িত।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে সীমিত সম্পদ ও সময়ের কারণে বৈশ্বিক ঐক্য, সহমর্মিতা এবং জ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ এখন জরুরি।
এই সম্মেলনের কেন্দ্রে ছিল CALL নেটওয়ার্কের উদ্বোধন। এটি সুইজারল্যান্ডের সহায়তায় নয়টি সুইস এনজিও এবং বাংলাদেশের আঠারোটি অংশীদার প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
- ক্রিশ্চিয়ান ব্লাইন্ড মিশন (CBM)
- এনফ্যান্টস ডু মন্ডে
- গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইম্প্রুভড নিউট্রিশন (GAIN)
- হেক্স/ইপিইআর
- হেলভেটাস বাংলাদেশ
- সলিডার সুইস
- সুইসকন্ট্যাক্ট
- সুইস রেড ক্রস
- টের দেস হোমস
এই নেটওয়ার্কের লক্ষ্য হলো স্থানীয় নেতৃত্বকে শক্তিশালী করা এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকে উৎসাহিত করা।
সমাপনী সেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা এম. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন:
“আমাদের নদীগুলো এবং এর ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন রক্ষা করতে হলে দক্ষতা বৃদ্ধি ও সবুজ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করা অপরিহার্য।”
প্রধান জলবায়ু শপথ পাঠ করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফজলুল কবির খান। তিনি সকলকে জলবায়ু সুরক্ষায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।
এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স করিন হেঁচো পিনিয়ানি এবং বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাত। করিন পিনিয়ানি বাংলাদেশের জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধির জন্য সুইজারল্যান্ডের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
জলবায়ু সচেতনতার পাশাপাশি এই আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। জনপ্রিয় ব্যান্ড জলের গান প্রকৃতি, নদী ও টিকে থাকার গল্প সুরের মাধ্যমে তুলে ধরে দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে। সমাপনী পরিবেশনা “ইকোস অফ দ্য ডেল্টা”—যেখানে নৃত্য, সঙ্গীত এবং গল্প বলার এক অনন্য সংমিশ্রণ দর্শকদের অনুপ্রাণিত করে।
এই আয়োজনের জলবায়ু যোগাযোগ অংশীদার ছিল যুব নেতৃত্বাধীন থিঙ্ক-অ্যান্ড-ডু ট্যাঙ্ক জেনল্যাব। তাদের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ফলে এই উৎসব মানুষ, জলবায়ু এবং সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে।
এই সম্মেলন প্রমাণ করেছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কেবল বৈশ্বিক ঐক্য নয়, স্থানীয় নেতৃত্বও সমান গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির পুনঃসংযোগের মাধ্যমে একটি টেকসই ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশ নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।