বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যশিল্পের উজ্জ্বল নিদর্শন অভয়নগরের ধুলগ্রাম। এখানে অবস্থিত দেওয়ানবাড়ি ও দ্বাদশ শিবমন্দির ছিল স্থানীয়দের গর্ব ও দর্শনার্থীদের বিস্ময়ের কেন্দ্রবিন্দু। একসময় প্রতিদিন শতশত মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকত এ প্রাঙ্গণ। যদিও আজ সময়ের প্রভাবে অনেক কিছুই ভগ্নাবশেষে পরিণত হয়েছে, তবুও বাতাসে এখনও ভেসে আসে অতীতের গৌরবগাথা।
দেওয়ানবাড়ি ছিল ধুলগ্রামের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। বাড়িটির সামনে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদী আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশছোঁয়া কালীমন্দির—এই অনন্য সমন্বয় দর্শকদের মুগ্ধ করত।
একসময় নদীর ঘাট ছিল শানবাঁধানো পাথরে ঝলমল করা, যা ভ্রমণকারীদের চোখে ধরত। কিন্তু ভৈরব নদীর ক্ষুধা ছিল অশেষ; ভেঙে নিয়েছে ঘাট ও গ্রাস করেছে অসংখ্য স্থাপত্য নিদর্শন। আজ ভাটার সময় নদীর তলদেশে উঁকি মারে ভগ্ন ইট-পাথরের স্তূপ, যেন হারানো ঐতিহ্যের মর্মস্পর্শী সাক্ষ্য বহন করছে।
ধুলগ্রামের কালীমন্দির নির্মাণ করেছিলেন রাজা নীলকণ্ঠরায়। দীঘি খননের সময় মাটির নিচে আবিষ্কৃত কালীমূর্তি তিনি এখানে প্রতিষ্ঠা করেন। চুন-সুরকির গাঁথুনিতে নির্মিত এই মন্দিরের প্রতিটি ইটে খোদিত দেব-দেবী, পশুপাখি ও বৃক্ষলতার শিল্পকর্ম আজও দর্শককে মুগ্ধ করে।
অদ্ভুত এক বিশ্বাস জড়িয়ে আছে মন্দিরটির সঙ্গে। পূজারীরা জানান, মন্দিরের মাথায় বাসা বাঁধা দুটি বড় কেউটে সাপ প্রতিবছর পূজার সময় দুধ-কলা দিয়ে সন্তুষ্ট করে নামানো হয়। স্থানীয়দের মতে, গভীর রাতে সাপদ্বয় পূজা দিতেও আসে। রহস্য ও বিশ্বাসের মিশেলে কালীমন্দির যেন অলৌকিক এক প্রতীক হয়ে উঠেছে।

ধুলগ্রামের পূর্বভিটিতে ছিল রামমন্দির। এখানে রাম, সীতা ও হনুমানের বিগ্রহ স্থাপিত ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাথরের তৈরি রামমূর্তিটি ভেঙে ফেলা হয়। তবুও দেয়ালে খোদিত শিলালিপি আজও জানিয়ে দেয় ইতিহাসের কথা—১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে চাঁচড়া মিত্রবংশীয় দেওয়ান হরিরাম মিত্র এ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
ধুলগ্রামের আরেক নিদর্শন গোপীনাথের জোড়বাংলো মন্দির। এখানে খোদিত শিলালিপি উল্লেখ করে যে হরিরাম মিত্র শ্রীহরির প্রতি প্রণতি জানিয়ে এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। প্রাঙ্গণের ঘরে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ আজও ভক্তির আবেগ জাগিয়ে তোলে।
দেওয়ানবাড়ির ইতিহাস শুধু স্থাপত্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বয়ে আনে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গৌরবের গল্প। দেওয়ান হরিরাম মিত্র থেকে শুরু করে তাঁর উত্তরসূরিরা প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রেখেছেন অনন্য অবদান। তাঁর বংশধর খগেন্দ্রনাথ মিত্র একসময় কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক, সাহিত্যপরিষদের সদস্য এবং ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
আজও ধুলগ্রামের মন্দিরে পূজার ঘণ্টাধ্বনি বাজে, কিন্তু অবহেলার কারণে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। ভগ্নপ্রায় দেওয়ানবাড়ি ও মন্দিরগুলো সংস্কারের অভাবে হারাচ্ছে তাদের আসল সৌন্দর্য। অথচ যথাযথ সংরক্ষণ ও যত্ন নিলে এই স্থাপনাগুলো আবারও ফিরে পেতে পারে অতীতের গৌরব, হয়ে উঠতে পারে বাংলার ঐতিহ্যের গর্ব।

ধুলগ্রাম শুধু অভয়নগরের নয়, সমগ্র বাংলার ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা আমাদের সবার দায়িত্ব। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে গর্বের সঙ্গে বলতে পারে—“ধুলগ্রাম ছিল শিল্প, সংস্কৃতি ও ভক্তিধারার এক উজ্জ্বল প্রতীক।”
অভয়নগরের ধুলগ্রামের ঐতিহাসিক স্থাপনা শুধু ভগ্নাবশেষ নয়, এগুলো বাংলার ঐতিহ্যের গৌরবময় অধ্যায়। সামান্য সচেতনতা ও সংস্কারমূলক উদ্যোগেই দেওয়ানবাড়ি ও দ্বাদশ শিবমন্দির ফিরে পেতে পারে হারানো গৌরব, আর বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারে বাংলার স্থাপত্য ঐতিহ্যের মহিমা।
✍️ জীবনী ও তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ০৪-সেপ্টেম্ববর ২০২৫