রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের নুরাল পাগলার মাজারে হামলার পর থেকে এলাকা এখনো থমথমে। মাজারের গেট বন্ধ, বাইরে পুলিশের পাহারা, মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর টহল চলছে। কাউকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া না হলেও আশেপাশের মানুষ ভিড় করছেন ক্ষতিগ্রস্ত মাজারটি দেখতে। এ আতঙ্কে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন।
শুক্রবারের ভয়াবহ হামলার পর শনিবার সকাল থেকে স্থানীয়রা আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকে আশঙ্কা করছেন, আবারও এমন হামলা হতে পারে।
রাজবাড়ীর মতো একই ঘটনা ঘটেছে রাজশাহীর পবা উপজেলার এক খানকায়। দলবদ্ধ মব প্রকাশ্যে ভাঙচুর চালিয়েছে পুলিশের সামনেই। শুধু মাজার নয়, ধর্ম অবমাননা বা রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা, রংপুরসহ দেশের নানা প্রান্তে একই ধরনের সহিংসতা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতেই এসব ঘটনা ঘটায় জনগণের আস্থা কমছে। অনেকেই মনে করছেন, কড়া বার্তা দিলেও বাস্তবে প্রশাসন বা সেনাবাহিনী তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় পুলিশ এবং সরকার দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে। অনেকে ভাবছেন, ব্যবস্থা নিলে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে উচ্ছৃঙ্খল একটি গোষ্ঠী।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলছেন, “মব সন্ত্রাস একবার ছাড় পেলে সেটি বারবার ঘটার ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে এখন সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।” তার মতে, মব কালচার ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে চাইলে প্রথমেই পুলিশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তার ভাষায়, “পুলিশ যদি আশঙ্কায় থাকে চাকরি হারানোর বা শাস্তির, তাহলে তারা কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে?”
তিনি আরও বলেন, “অন্যায় করলে পুলিশের বিচার হতে হবে, তবে তাদের সঙ্গে অন্যায় হলে তারও সঠিক বিচার জরুরি।”
স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, নুরাল পাগলার মৃত্যুর পর থেকেই মাজারটি নিয়ে উত্তেজনা চলছিল। তার কবর বিশেষ কায়দায় দাফন করা হয়, যা নিয়ে আলেম সমাজ ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিল।
ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি কবর সমতল করা ও মাজারের কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানায়। জুমার নামাজের পর “মার্চ ফর গোয়ালন্দ” কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল তারা। প্রশাসনের সঙ্গে বারবার আলোচনা হলেও সমাধান হয়নি।
শুক্রবার নামাজের পর শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা বলে হঠাৎই অস্ত্র ও ইট-পাটকেল নিয়ে হামলা চালানো হয়। যদিও পুলিশ দাবি করছে, তারা হামলা ঠেকাতে চেষ্টা করেছিল।
রাজশাহীর পবায় খানকা শরিফে ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে তিন দিনের আয়োজন চলছিল। আগেই হামলার শঙ্কা থাকায় পুলিশ মোতায়েন ছিল। তবুও মব ভাঙচুর চালায়। অনেকেই অভিযোগ করছেন, পুলিশ ঘটনাস্থলে থেকেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।২৮ আগস্ট ঢাকার “মঞ্চ ৭১” অনুষ্ঠানে একদল মব আলোচকদের হেনস্তা করে। হামলাকারীদের বদলে ভুক্তভোগীদেরই গ্রেফতার করে পুলিশ।৯ আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জে মব পিটিয়ে হত্যা করে দুই ব্যক্তিকে।২৬-২৭ জুলাই রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। পুলিশ উপস্থিত থাকলেও মব ঠেকাতে ব্যর্থ হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আশ্বাস দিলেও বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের নিরবতা অপরাধীদের সাহস যোগাচ্ছে। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি অভিযোগ করেছে, সরকারের সমর্থন বা অবহেলায় দেশে “মবোক্রেসি” চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব সন্ত্রাস দমন না হলে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমবে। সাধারণ মানুষ নিজেরাই আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা দেখাতে পারে। এতে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে।
পুলিশের সাবেক প্রধান নুরুল হুদা মনে করেন, “সরকারের উচিত আরও কঠোর হওয়া। না হলে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলবে, এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
সূত্র: বিবিসি বাংলা।