বাংলাদেশে শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইপিআই (Expanded Program on Immunization) কর্মসূচি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি জেলায় টিকার ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা শিশুদের নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়টি স্বীকার না করলেও মাঠপর্যায়ের তথ্য বলছে, টিকা সংকটের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মসূচি বিলম্বিত হচ্ছে।
বিভিন্ন জেলায় টিকা ঘাটতির চিত্র
গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর ও কুমিল্লায় শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় টিকার ঘাটতি চলছে।চাঁদপুর জেলা: সিভিল সার্জন ডা. নূর আলম দীন জানিয়েছেন, পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন দীর্ঘদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের এই টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও সরবরাহে বিলম্ব হচ্ছে।মানিকগঞ্জ জেলা: প্রায় এক মাস ধরে ওপিভি, পেন্টা, পিসিভি এবং আইপিভি টিকা স্টক আউট হয়ে আছে বলে জানান স্থানীয় সিভিল সার্জন।মুন্সিগঞ্জ জেলা: সিভিল সার্জনের দাবি, স্বল্প সময়ের জন্য সংকট থাকলেও বর্তমানে প্রয়োজনীয় টিকা মজুদ আছে।গাজীপুর জেলা: সাময়িক সংকট কেটে গেছে এবং নতুন সরবরাহ আসায় উপজেলা পর্যায়ে বিতরণ শুরু হয়েছে।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ভিন্নমত
যেখানে স্থানীয় সাংবাদিকরা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘাটতির কথা জানাচ্ছেন, সেখানেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিষয়টি স্বল্পতা নয় বরং “সরবরাহের দেরি” হিসেবে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
প্রকল্পের ম্যানেজার ডা. এ এফ এম সাহাবুদ্দিনের দাবি, টিকা একসাথে দেশে না আসায় জেলায় পাঠাতে কিছুটা সময় লাগে। তবে এটিকে সংকট বলা যাবে না।
প্রতি বছর টিকাদান কর্মসূচি ও লক্ষ্য
বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪০ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া হয়।২০২৪ সালে প্রায় ৩৯ লাখ শিশুকে টিকা দেওয়া হলেও ২০২৫ সালে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ লাখে।বিভিন্ন টিকার ডোজ আলাদা হওয়ায় গড় হিসাব কিছুটা ওঠানামা করে।
টিকা কেনার নতুন প্রক্রিয়া
আগে বাংলাদেশ বিনামূল্যে টিকা পেত গ্লোবাল ফাউন্ডেশন থেকে, কিন্তু এখন থেকে সরকারকেই কিনতে হচ্ছে।ইউনিসেফের মাধ্যমে ক্রয়: ২০২৪ সাল থেকে ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ এই টিকা কিনছে।সরকারি তহবিল: এখন নিজস্ব অর্থায়নে ক্রয় করা হয় এবং পরে জনগণকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়।টেন্ডার প্রক্রিয়া: টিকা কেনার জন্য টেন্ডার ও আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, ফলে সরবরাহে দেরি হয়।
ইপিআই টিকার ধরন ও রোগ প্রতিরোধ
ইপিআই কর্মসূচির আওতায় শিশুরা বিভিন্ন সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষা পায়। এর মধ্যে রয়েছে—বিসিজি টিকা: যক্ষার বিরুদ্ধে।ওপিভি (পোলিও টিকা): পোলিওমাইলাইটিস প্রতিরোধে।পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন: ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি ও হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে।পিসিভি: নিউমোনিয়া প্রতিরোধে।এমআর ভ্যাকসিন: হাম ও রুবেলা থেকে রক্ষা করে।টিটেনাস টক্সয়েড (টিটি): ধনুষ্টংকার প্রতিরোধে।
শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্ব
বাংলাদেশে ১৯৭৯ সালে ইপিআই কর্মসূচি চালু হওয়ার আগে প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ শিশু প্রতিরোধযোগ্য রোগে মারা যেত। বর্তমানে টিকাদান কর্মসূচির কারণে শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
সরকারি তথ্যমতে, শূন্য মাস বয়স থেকে শুরু করে কিশোরী ও সন্তান ধারণক্ষম নারীদের জন্যও ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
সংকট কাটানোর উপায়
- সরবরাহ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন: জেলায় জেলায় সময়মতো টিকা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয়: উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ নিশ্চিত হলে হঠাৎ সংকট এড়ানো সম্ভব।স্বচ্ছ যোগাযোগ: মাঠ পর্যায়ের তথ্য ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের বিবৃতির মধ্যে ফাঁক কমাতে হবে।