কেরল হাইকোর্ট সম্প্রতি এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যৌনকর্মীরা কখনওই কোনও “পণ্য” নন। তাই তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও মামলায় খদ্দের বা ক্রেতা শব্দ ব্যবহার অনুচিত। আদালত জানায়, মানবপাচারের মাধ্যমে অনেক সময় মানুষকে এই পেশায় ঠেলে দেওয়া হয় এবং তাঁদের অপমানজনকভাবে “পণ্য” আখ্যা দেওয়া আইনের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।
নারীপাচারের মামলা ও ঘটনাপ্রবাহ
২০২১ সালে কেরলের তিরুঅনন্তপুর থানার পুলিশ এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ ছিল, তিনি এক যৌনপল্লিতে এক মহিলার সঙ্গে ধরা পড়েছিলেন। পুলিশের দাবি অনুযায়ী, অভিযুক্তকে সেসময় বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর মানবপাচার সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের হয়।
অভিযুক্ত হাইকোর্টে আবেদন জানান যে, তিনি কেবল একজন খদ্দের বা “গ্রাহক” ছিলেন, তাই তাঁর বিরুদ্ধে মানবপাচারের মামলা টেকসই নয়।
কেরল হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ
বিচারপতি ভিজি অরুণের বেঞ্চ এই মামলার শুনানিতে গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন: যৌনকর্মী কোনও পণ্য নন: আদালত জানায়, খদ্দের বলতে সাধারণত এমন কাউকে বোঝায় যিনি কোনও পণ্য বা পরিষেবা কিনছেন। কিন্তু যৌনকর্মীকে পণ্য হিসেবে দেখা আইন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।প্ররোচনার প্রশ্ন: আদালতের মতে, কোনও ব্যক্তি যখন যৌনপল্লিতে টাকা দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তখন তিনি সেই যৌনকর্মীকে এই কাজে চালিয়ে যেতে প্ররোচিত করছেন।মানবপাচারের শিকার: অধিকাংশ যৌনকর্মী জোরপূর্বক বা প্রতারণার মাধ্যমে এই পেশায় আসতে বাধ্য হন। ফলে তাঁদের অপরাধী নয়, বরং ভুক্তভোগী হিসেবে দেখতে হবে।
আইন ও খদ্দেরের সংজ্ঞা
অনৈতিক পাচার (প্রতিরোধ) আইন, ১৯৫৬
এই আইন মূলত মানবপাচার প্রতিরোধে প্রণীত। আদালত স্পষ্ট করে জানায়, যৌনকর্মীদের শাস্তি দেওয়া নয়, বরং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াই এর মূল লক্ষ্য।খদ্দের শব্দ ব্যবহার করলে বোঝায় তিনি কেবল ক্রেতা।কিন্তু যৌনপল্লিতে গিয়ে টাকা প্রদান মানে যৌনকর্মীকে প্ররোচিত করা, যা আইনত অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।তাই অভিযুক্তকে কেবল “খদ্দের” হিসেবে বিবেচনা করলে আইন তার উদ্দেশ্য হারাবে।
আদালতের চূড়ান্ত রায়
কেরল হাইকোর্ট অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ খারিজ করেনি। যদিও কয়েকটি ধারা বাদ দেওয়া হয়, তবুও অনৈতিক পাচার (প্রতিরোধ) আইনের আওতায় বিচার মুখোমুখি হতে হবে। আদালত জোর দিয়ে বলে, যৌনপল্লিতে গিয়ে টাকা দেওয়া মানে ওই ব্যক্তির পরোক্ষভাবে যৌনকর্মীকে এই কাজে বাধ্য রাখা।
সমাজে এই রায়ের প্রভাব
কেরল হাইকোর্টের এই রায় সমাজে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে: যৌনকর্মীর মানবিক মর্যাদা স্বীকৃত হলো।আইনের অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে।মানবপাচারের শিকার নারীরা বা পুরুষেরা ভুক্তভোগী হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।যৌনপল্লির গ্রাহকরা অপরাধের অংশীদার হিসেবে ধরা হবে।
উপসংহার
কেরল হাইকোর্টের এই ঐতিহাসিক রায় মানবাধিকার ও নারীর মর্যাদা রক্ষার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আদালতের স্পষ্ট বার্তা হলো—যৌনকর্মী কোনও পণ্য নন, তাঁদের পেশা গ্রহণে বাধ্য করা অন্যায়, আর গ্রাহকের ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিরাও দায় এড়াতে পারবেন না।
এটি কেবল এক মামলার রায় নয়, বরং ভবিষ্যতে মানবপাচার বিরোধী লড়াই ও যৌনকর্মীদের অধিকারের ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।