ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে সাহস ও সংকল্পের এক চরম উদাহরণ গড়ে গেলেন ঋষভ পন্থ। ভাঙা পায়ে ৫৫ মিনিট ব্যাট করে ২৭ বলে ১৭ রান করা শুধু সংখ্যার খেলা নয়, এটি একজন যোদ্ধার গল্প। এক হার না মানা মনোভাবের প্রতিচ্ছবি, যা গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে।
ভাঙা পায়ে পন্থের মাঠে নামা: এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত
বুধবার চতুর্থ টেস্টের প্রথম দিনে ডান পায়ে ভয়াবহ চোট পান ঋষভ পন্থ। তাঁকে স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। গোটা ভারতীয় শিবির যখন ধোঁয়াশার মধ্যে, তখনই বৃহস্পতিবার ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে মাঠে নামলেন পন্থ, পায়ে গভীর চোট নিয়েও।
সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হলেও মাঠে নামতে দ্বিধা করেননি পন্থ। সময় নিয়েছেন, রেলিং ধরে সাবধানে নেমেছেন, কিন্তু তাঁর চোখে ছিল স্পষ্ট সংকল্প। সাজঘর থেকে বেরিয়ে যখন পন্থ মাঠ ছুঁয়ে প্রণাম করলেন, তখন গোটা স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানাল।
ক্রিকেটীয় শিষ্টাচার ও প্রতিপক্ষের সম্মান
পন্থ যখন ব্যাট করতে নামছিলেন, তখন প্রায় ২ মিনিট সময় পেরিয়ে গিয়েছিল। চাইলে ইংল্যান্ড অধিনায়ক বেন স্টোকস ‘টাইমড আউট’-এর আবেদন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং অপেক্ষা করে নিজের প্রতিপক্ষের সাহসিকতাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এটিই ক্রিকেটের প্রকৃত সৌন্দর্য।
চোটগ্রস্ত শরীর, অবিচল মানসিকতা
ঋষভ পন্থের পায়ের পাতা এতটাই ফুলে গিয়েছিল যে সোজা হাঁটাও ছিল কষ্টকর। দৌড়নো তো দূরের কথা, হালকা ‘জগিং’ করেই এক একটি রান তুলেছেন। শট নেওয়ার সময় পায়ের নড়াচড়াতেও দেখা গেছে আড়ষ্টতা। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটিও সহজ রান ছেড়ে দেননি তিনি। ইয়র্কার, শর্ট বল—সব কিছুর মুখোমুখি হয়েছেন। ব্যথা সহ্য করে ব্যাট চালিয়েছেন, তা যেন এক যন্ত্রণার সাথে প্রতিরোধের যুদ্ধ।
সংখ্যার বাইরেও রয়েছে আত্মত্যাগের গল্প
বুধবার চোট পাওয়ার আগে পন্থ করেছিলেন ৪৮ বলে ৩৭ রান। চোট পাওয়ার পরে আরও ২৭ বলে ১৭ রান করে যান। চার মেরেছেন, ছয়ও মেরেছেন। এই ছয় দিয়েই তিনি ভারতীয়দের মধ্যে টেস্টে সবচেয়ে বেশি ছয় মারার রেকর্ড গড়ে ফেলেন। কিন্তু আসল কৃতিত্ব শুধু স্কোরবোর্ডে নয়—এর গভীরে রয়েছে এক অনন্য আত্মত্যাগ।
সতীর্থদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠলেন পন্থ
যখন পন্থ মাঠে নামেন, তখন ভারতের স্কোরকার্ড ও মনোবল দুটোই নড়বড়ে অবস্থায়। তাঁর সাহসিক লড়াই দলের সাজঘরে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। শুভমন গিল, সিরাজ, বুমরাহ—তাঁদের ব্যাটিংয়ে আত্মবিশ্বাস দেখা যায়, যা হয়তো পন্থের থেকেই সংক্রমিত হয়েছে।
ভারতীয় ক্রিকেটের সাহসী ইতিহাসে পন্থের জায়গা পাকা
এর আগে অনিল কুম্বলে ভাঙা চোয়াল নিয়ে খেলেছেন। নরি কনট্রাক্টর ভাঙা পাঁজর নিয়ে মাঠে নেমেছেন। কপিল দেব, দিলীপ দোশী, বিজয় মঞ্জরেকররাও খেলেছেন চোট নিয়েই। এখন সেই ঐতিহাসিক তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ঋষভ পন্থ। এ শুধু সাহসিকতার গল্প নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় অধ্যায়।
‘লগান’ সিনেমার ইসমাইল থেকে বাস্তবের পন্থ: সিনেমার মতোই লড়াই
অনেকেই এই ইনিংসের তুলনা করেছেন বলিউড সিনেমা ‘লগান’-এর ‘ইসমাইল’-এর সঙ্গে, যিনি পায়ে আঘাত পেয়েও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক তেমনভাবেই পন্থকেও দেখা গেছে বাস্তবের মঞ্চে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ইনিংস শুধু একটি সিরিজ নয়, ভারতীয় ক্রিকেট সংস্কৃতিরও পুনর্জন্ম ঘটিয়েছে।
পন্থের ইনিংসের প্রভাব: দলের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি
তার ইনিংস হয়তো দলের স্কোরবোর্ডে বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। কিন্তু মনের ভিতর আত্মবিশ্বাস আর দায়িত্ববোধ জাগিয়েছে। বুমরাহ ও সিরাজের দশম উইকেটের জুটি, ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠেছে। সহ-অধিনায়ক হিসেবে পন্থ দলকে দেখিয়ে দিয়েছেন—দায়িত্ব কেমনভাবে নিতে হয়।
আবারও প্রমাণ করলেন—ঋষভ পন্থ এক যোদ্ধা
ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনার পর ফিরে এসে আবার ব্যাট হাতে দলের জন্য এমন লড়াই—এ যেন সিনেমার থেকেও বেশি নাটকীয় ও আবেগঘন। পন্থ বারবার প্রমাণ করছেন, তিনি শুধু উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান নন, তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের সাহসিক মুখ।