বাংলার গ্রামীণ জীবনে বিল, পুকুর, ধানক্ষেত ও প্রকৃতি এক অদ্ভুত মেলবন্ধনে মিশে থাকে। সেই মেলবন্ধনের এক অসাধারণ সাক্ষ্য বহন করে দুবলের বিল। গত বছর এক সন্ধ্যার আগে আমরা হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের উত্তর পাশের এই বিলের ধারে পৌঁছেছিলাম। সীমান্তবর্তী এই বিল কেবল জলাভূমি নয়; এটি আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি, প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্য এবং জীবনের অমূল্য অভিজ্ঞতার এক চিরন্তন আখ্যান।
দুবলের বিলের পশ্চিমে ভারতের বাগদা থানার বাজিতপুর, আর উত্তরে রয়েছে কুড়ুলিয়া ও মেহেরানি গ্রাম। একসময় সারা বছরই এই বিলে পানি থাকত। দুই দেশের মানুষ মিলেমিশে এই বিল থেকে মাছ ধরত, জীবন ধারণ করত। সীমান্তের ধারে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই খোলা জলাশয় যেন দুই বাংলার মানুষকে একই সুতোয় বেঁধে রেখেছিল।
বর্ষা এলে দুবলের বিল এক নতুন রূপ পায়। থই থই পানির ঢেউ, শেওলা ও শোলা গাছের সবুজ মায়া আর চারদিকে ছড়িয়ে পড়া শাপলার সমারোহ বিলটিকে করে তোলে অপরূপ। নীল আকাশের সঙ্গে মিলে শাপলার সাদা ও নীল পাপড়ি যেন আঁকে এক মোহনীয় দৃশ্যপট। শাপলার মাঝ দিয়ে ডুবু ডুবু পানি ভেদ করে যখন আলো পড়ে, তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন নিজের হাতে এঁকেছে এক জীবন্ত ছবি।
দুবলের বিল কেবল জল নয়, এটি জীববৈচিত্র্যের এক অমূল্য ভাণ্ডার।চখাচখি পাখি ডানায় ভর দিয়ে পানির উপর ভেসে বেড়ায়, কখনও আবার ডুব দিয়ে মাছ ধরে।সাদা বক ধানক্ষেতের কিনারায় উড়ে বেড়ায়, তাদের ডাকে প্রকৃতি আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।পানির উপর ঘূর্ণি পোকা ঘুরে কুমোরদের চাকার মতো নৃত্য করে, যা এক অপূর্ব দৃশ্য।
প্রকৃতির এই অবারিত মায়া মানুষকে বারবার টেনে নিয়ে আসে বিলে।
দুবলের বিল গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় উৎস। মাছুরে কৃষকরা বাঁশ পুঁতে টোঙ বানায়, টোঙের নিচে বাঁধা থাকে ছোট ডোঙ্গা। সেই ডোঙ্গাতেই রাতদিন কষ্ট করে মাছ ধরে পরিবার চালায় তারা। বর্ষার পানি যখন চারিদিক ভরিয়ে দেয়, তখন তাদের জীবন কেবল টিকে থাকার সংগ্রাম নয়, প্রকৃতির সঙ্গে এক অদৃশ্য লড়াইও বটে।
আমাদের ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বিলকে ঘিরে।স্কুল থেকে ফিরে আমরা বিলে নেমে যেতাম।শোলা কেটে মাঝখানে নাইলনের দড়ি বেঁধে বড়শীতে কোঁচো গেঁথে মাছ ধরতাম।ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে ডোঙ্গায় বসে ছিপ ফেলা ছিল এক অন্যরকম আনন্দ।
ধানগাছের ধারালো পাতায় গায়ে আঁচড় লাগত, ক্ষত হতো, কিন্তু সেই ব্যথাতেও ছিল আনন্দ। সোনালী সেই দিনগুলো আর ফিরে আসে না, শুধু মনে পড়ে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
দুবলের বিলের চারদিকে তাকালে মনে হয় আকাশ নেমে এসেছে গাছপালার মাথায়। প্রকৃতির প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় রয়েছে নিখুঁত শিল্পকর্মের ছোঁয়া। স্থির পানির ওপর আলো-ছায়ার খেলা, শাপলার সাদা-নীল রঙের মিশ্রণ, পাখিদের উড়াউড়ি—সব মিলিয়ে প্রকৃতি এক সুষমার মঞ্চ তৈরি করেছে।
এই প্রকৃতির সঙ্গে একবার ঘনিষ্ঠ হলে মানুষের মন শান্ত হয়, হৃদয় ভরে ওঠে প্রশান্তিতে।
দুবলের বিল শুধু সৌন্দর্যের নয়, এটি গ্রামীণ জীবনের রোজগার ও বেঁচে থাকার অবলম্বন।কৃষকরা এখানে মাছ ধরে সংসার চালায়।গবাদি পশুর জন্য ঘাস কাটে।বর্ষায় মাছ ধরার মৌসুমে গ্রামের চারপাশ যেন উৎসবে মেতে ওঠে।
ছবির মতো দৃশ্য—সন্ধ্যার আগে সীমান্তের বিল থেকে ঘাস কেটে ফিরছে রবিউল ইসলাম, সঙ্গে তার ছেলে রিংকু—গ্রামীণ জীবনের সেই বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলে।
আজকের দিনে বিলে আর আগের মতো পানি থাকে না, আগের প্রাণবন্ত দৃশ্যও হারিয়ে গেছে অনেকটা। কিন্তু এই বিলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আমাদের শৈশবের স্মৃতি এখনও অম্লান। যদি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা যায়, তাহলে দুবলের বিল আবার তার আগের রূপে ফিরতে পারে, হতে পারে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের এক অভয়ারণ্য।
দুবলের বিল শুধু একটি জলাশয় নয়, এটি বাংলার প্রকৃতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মানুষের আবেগের প্রতিচ্ছবি। ছোটবেলার খেলাধুলা থেকে শুরু করে কৃষকের সংগ্রাম, পাখিদের কলরব থেকে শাপলার মোহনীয় সৌন্দর্য—সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত চিত্রকাব্য।
✍️ তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ১৬ আগস্ট ২০২৫