যশোরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিয়ের পাত্রী সন্ধান এবং ঠাকুর পরিবারের আত্মীয়তার সূচনা: ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়

যশোরে রবীন্দ্রনাথের বিয়ের পাত্রী খোঁজ ও ঠাকুর পরিবারের আত্মীয়তার সূচনা নিয়ে জানা অজানা এক ঐতিহাসিক গল্প। ছেলেরা কুড়ি বছরের আগেই বিবাহবন্ধনে

ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে বিয়ের প্রথা ছিল একটি চিরাচরিত রীতি—ছেলেরা কুড়ি বছরের আগেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই নিয়মের এক ব্যতিক্রম। বয়স তেইশ পার করেও যখন তাঁর উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন পরিবারের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কলকাতার বাইরেও খোঁজ করতে হবে। সেই খোঁজের সূত্র ধরেই শুরু হয় যশোর যাত্রা

যশোর যাত্রা: কনে সন্ধানে নরেন্দ্রপুর অভিমুখে

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর স্ত্রী কাদম্বরী দেবী, এবং আত্মীয়া জ্ঞানদানন্দিনী দেবী মিলে পাড়ি জমালেন যশোর সদরের নরেন্দ্রপুর—এলাকার এক অভিজাত ও সুপ্রতিষ্ঠিত গ্রাম, যা ছিল জ্ঞানদানন্দিনীর পৈত্রিক নিবাস।

জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরা দেবী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ রবীন্দ্র স্মৃতি’-তে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন:

রবি কাকার কনে খুঁজতে মা (জ্ঞানদানন্দিনী), নতুন কাকীমা (কাদম্বরী দেবী), জ্যোতি কাকা আর রবি কাকা একসাথে যশোরে গিয়েছিলেন। আমরা দুই বোন যদিও সেই দলে ছিলাম না, শুনেছি তাঁরা নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ডিহি, চেঙ্গুটিয়ার মতো গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিবাহযোগ্য মেয়ের খোঁজ করছিলেন।”

ভাগ্যের পরিহাস: যশোরে না মিলল উপযুক্ত কনে

যদিও যাত্রা শুরু হয়েছিল আশাবাদ নিয়ে, কিন্তু বাস্তব ছিল হতাশাজনক। যশোরের প্রখ্যাত অনেক পরিবারে খোঁজ চালিয়েও রবির জন্য যথার্থ রূপে, বয়সে বা গুণে উপযুক্ত কনে খুঁজে পাওয়া গেল না। যেন পুরো যশোর অঞ্চল সেদিন “কনেদের মরুভূমি” হয়ে উঠেছিল।

ফের কলকাতা অভিমুখে: ভবতারিনীর সন্ধান

পরবর্তীতে ফের ফিরে যাওয়া হয় কলকাতায়, যেখানে ঠাকুর পরিবারের কাছারি বাড়িতে কাজ করতেন বেনীমাধব রায় চৌধুরী। তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা ভবতারিনী—যিনি পরবর্তীতে মৃণালিনী দেবী নামে পরিচিত হন—তাঁকেই মনোনীত করা হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে

গবেষণার আলোকে: প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্যে

রবীন্দ্র গবেষক প্রভাত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন:

১৮৮৩ সালের পুজোর ছুটিতে বাস্তুভিটা দেখার নাম করে জ্ঞানদানন্দিনী যশোরের নরেন্দ্রপুরে যান। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন—পীরালি পরিবারের মধ্য থেকে পুত্রবধূ নির্বাচন। একদা ফুলতলার বেনীমাধব রায়ের কন্যা ভবতারিনীকে দেখে তাঁরা মুগ্ধ হলেন।”

বিয়ের আয়োজন: প্রথার বাইরে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব সিদ্ধান্ত

তৎকালীন সমাজে মেয়ের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন ছিল প্রচলিত। কিন্তু কবিগুরু নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন, না, কন্যা আহ্বানে হবে বিয়ে!” অর্থাৎ, পাত্রী আসবেন পাত্রের বাড়িতে। এই সিদ্ধান্তে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাত্রপক্ষের বাড়ি জোড়াসাঁকোতেই আয়োজন হয়।

বিয়ের খরচ নিমন্ত্রণপত্র: এক ঐতিহাসিক দলিল

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ হাতে বিয়ের সব খরচ বহন করেন:

  • পাথেয় খরচ: ৬০ টাকা
  • বাড়ি ভাড়া: ২২ টাকা তিন পাই

এই খরচের বিবরণ আজও ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তার ক্যাশবইয়ে লিপিবদ্ধ আছে।

রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেন হাতে লেখা এক চিঠিতে:

আগামী রবিবার ২৪ অগ্রহায়ণ তারিখে শুভ দিনে শুভ লগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে উক্ত দিবসে নম্বর জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্পন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয় বর্গকে বাধিত করিবেন। – ইতি অনুগত শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”

বিয়ের রীতি: যশোর-খুলনার হিন্দু প্রথা অনুসরণে

বিয়েতে ব্রাহ্ম ধর্মের কোনো প্রথা অবলম্বন করা হয়নি। বরং যশোর-খুলনার হিন্দু বিয়ের রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। হয়তো এটি রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে প্রচলিত প্রথা ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে যাওয়ার সচেতন প্রয়াস

বিয়ের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশ যশোরের উল্লেখ

সাধারণী’ পত্রিকায় বিয়ের ঠিক নয় দিন পর একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়, যেখানে লেখা ছিল:

গত রবিবারে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ অতি সমারোহের সহিত সুসম্পন্ন হইয়াছে। পাত্রীটিকে যশোর হইতে আনা গিয়াছে।”

এই একটি বাক্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়, যশোরের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের আত্মীয়তার সূচনা হয়েছিল এই বিয়ের মাধ্যমেই

বিয়ের অজানা পর্দার আড়ালে এক নিখুঁত ইতিহাসচর্চা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের এই বিয়ের অধ্যায় কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করেযশোর ভ্রমণ, কনে খোঁজা, ঐতিহ্যগত প্রথা ভাঙা এবং আত্মীয়তা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এক যুগান্তকারী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই ঘটনা ঠাকুর পরিবারের বৃত্তে যশোরের নাম স্থায়ীভাবে যুক্ত করে দেয়।

✍️ জীবনী তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২৫

লেটেস্ট আপডেট...

আইপিএল স্পেশাল...

যশোর ক্রীড়া সংস্থায় কাজী এনামের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে উত্তেজনা: ঘেরাও, স্মারকলিপি ও প্রতিবাদের ঝড়

যশোর ক্রীড়া সংস্থার এডহক কমিটিতে বিসিবির সাবেক পরিচালক কাজী এনাম আহমেদকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত ঘিরে স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠক, খেলোয়াড় ও ক্রীড়াপ্রেমীদের মধ্যে...

সেলিব্রেটি গসিপ...

মেগান মার্কেলের উদ্বেগ: প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে রাজা চার্লসের মিলন ঘিরে নতুন বিতর্ক

প্রিন্স হ্যারি এ সপ্তাহে লন্ডনে ফিরেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি যোগ দিচ্ছেন WellChild Awards-এ, তবে আড়ালে আলোচনার বিষয় হচ্ছে—তিনি কি তাঁর দূরত্ব তৈরি হওয়া বাবা, রাজা...

সম্পর্কিত আরও পড়ুন...

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Translate »