বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে এমন কিছু নাম রয়েছে, যাদের উপস্থিতি মুহূর্তের জন্য হলেও আকাশকে আলোকিত করেছে বজ্রের মতো। সুকান্ত ভট্টাচার্য সেই নামের অন্যতম। অল্পায়ু জীবনে তিনি যা রেখে গেছেন, তা শুধু কবিতা নয়, বরং প্রতিরোধের অস্ত্র, সংগ্রামের শপথ এবং মানবতার চিরন্তন দীপশিখা। তিনি ছিলেন ক্ষুধার্তের কণ্ঠস্বর, শোষিতের অগ্নি, নিপীড়িতের বিদ্রোহ। মাত্র একুশ বছরের জীবনে তিনি দেখিয়েছিলেন, সময় নয়—প্রতিজ্ঞাই মানুষকে অমর করে তোলে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট, কলকাতার কালীঘাট এলাকায়। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলায়। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল মধ্যবিত্ত, কিন্তু সাহিত্য ও সংস্কৃতির আবহে তাঁর বেড়ে ওঠা। কৈশোর থেকেই তিনি লিখতে শুরু করেন, এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর কবিতা ও চিন্তার দিক থেকে আলাদা হয়ে ওঠেন।
কৈশোরের বয়সেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে কলকাতার রাস্তায় অগণিত মৃতদেহের স্তূপ। এই দৃশ্যগুলো তাঁর কবিতার ভেতর দগ্ধ আগুন হয়ে ফুটে ওঠে।
সুকান্ত ছিলেন গভীরভাবে প্রভাবিত মার্কসবাদী আদর্শে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কবিতা কেবল সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়; বরং শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার। তাই তাঁর কবিতায় প্রেম আছে, কিন্তু সেই প্রেম শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
তাঁর সবচেয়ে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘ছাড়পত্র’ (১৯৪৭) প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোই তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব দিয়েছে। বিশেষ করে তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙক্তি যেন যুগপৎ বিদ্রোহ, প্রেম, এবং দায়িত্ববোধের শপথ।
যদিও তিনি মার্কসবাদী, তবুও তাঁর আত্মা বারবার ছুটে গেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখতেন মানবতার প্রতীক হিসেবে। তাই তো তিনি লিখেছিলেন—
“আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ,আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের।”
এই পঙক্তি প্রমাণ করে, সুকান্ত শুধু বিদ্রোহী নন, তিনি ছিলেন মানবতার কবি। তাঁর কবিতায় যেমন ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার আছে, তেমনি আছে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ থেকে পাওয়া আলোকবর্তিকা।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা নিছক সাহিত্য নয়; বরং তা দরিদ্র, শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের জীবনের দলিল। তাঁর কবিতার ভেতর ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার যেমন শোনা যায়, তেমনি শোনা যায় তাদের বিদ্রোহের ডাক।
তিনি লিখেছিলেন—
“এই নবান্নে প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ?”
এ যেন নিছক প্রশ্ন নয়, বরং সময়কে ছুঁড়ে দেওয়া বিদ্রোহী উচ্চারণ। তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙক্তি সাধারণ মানুষের ক্ষুধা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক অগ্নিঝরা প্রতিবাদ।
সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র একুশ বছর বয়সে ১৯৪৭ সালের ১৩ মে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু এত অল্প সময়ে তিনি যে সৃষ্টি রেখে গেছেন, তা বাংলা সাহিত্য ও সমাজ ভাবনার ইতিহাসে অনন্য।
তাঁর মৃত্যু হয়েছিল এমন সময়ে, যখন ভারত ভাগের অশান্তি, দুর্ভিক্ষ এবং সামাজিক বৈষম্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। এই বাস্তবতা তাঁকে মুছে দেয়নি; বরং তাঁকে আরও অমর করে তুলেছে।
সুকান্তের সাহিত্যকর্ম যদিও সংখ্যায় বেশি নয়, তবুও তা গভীরতা ও শক্তিতে ভরপুর। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—ছাড়পত্র (১৯৪৭), ঘুম নেই (১৯৫৪), মুক্তি (১৯৭২), পূর্বরাগ (১৯৭৪), হারানো খাতা (১৯৭৬) এছাড়া তাঁর লেখা ছড়া ও ছোট কবিতাগুলো আজও বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয়।
বাংলা সাহিত্যে সুকান্ত ভট্টাচার্যের অবদানকে কয়েকটি দিক থেকে মূল্যায়ন করা যায়—ক্ষুধার্ত ও শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর
তাঁর কবিতা ছিল নিপীড়িত মানুষের মুখপত্র।মার্কসবাদী চিন্তার প্রতিফলন সাহিত্যকে সংগ্রামের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।যুবশক্তির প্রতীক অল্প বয়সেই তিনি প্রমাণ করেছেন, তরুণরা সমাজ পরিবর্তনের অনন্য শক্তি।রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক রবীন্দ্রপ্রেম তাঁকে মানবতার আলোয় আলোকিত করেছে।
আজও যখন সমাজে দারিদ্র্য, শোষণ ও বৈষম্য বিদ্যমান, তখন সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তাঁর কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাহিত্য কেবল শিল্প নয়, বরং মানুষের মুক্তির হাতিয়ার।
তরুণ প্রজন্মের কাছে সুকান্ত শুধু এক কবির নাম নয়; তিনি এক অনন্ত প্রতীক—সংগ্রামের, প্রতিবাদের, ও আশার।
সুকান্ত ভট্টাচার্য ছিলেন বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক ঝলকানি, যিনি খুব অল্প বয়সে বজ্রের মতো এসে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁর কবিতা নিছক সাহিত্য নয়, বরং মানবতার সংগ্রামের অগ্নিপর্ব। তিনি প্রমাণ করে গেছেন—সময় নয়, প্রতিজ্ঞাই মানুষকে অমর করে তোলে।
✍️ জীবনী ও তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ১৬ আগস্ট ২০২৫