৪৫ বছর আগে আজকের দিনে আমরা হারিয়েছি বাংলা চলচ্চিত্রের এক অবিসংবাদিত সম্রাটকে—উত্তমকুমার। কিন্তু সময় যতই পেরিয়ে যাক, উত্তমকুমার হারান না। তাঁর হাসি, চোখের অভিব্যক্তি, সংলাপ বলার কৌশল, রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি—সবই আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি শুধু নায়ক ছিলেন না, ছিলেন একটি অনুভব, একটি যুগের প্রতিনিধি, একজন কালজয়ী শিল্পী।
🌟 বাংলা সিনেমায় উত্তমকুমার: শুরু, সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প
অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় নামে জন্ম নিয়ে সিনেমায় পা রেখেছিলেন এক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সেই শুরুটা ছিল বহু বাঁধা-বিপত্তিতে ভরা। ‘দৃষ্টিদান’ ছবির মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে আত্মপ্রকাশ করলেও একের পর এক ছবির ব্যর্থতা তাঁকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। তখনকার নাম ‘অরুণকুমার’ বদলে নাম নেন ‘উত্তমকুমার’, এবং শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।
এই অধ্যায়ের প্রথম মোড় আসে ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে সেই সিনেমা তাঁকে এনে দেয় বিরাট জনপ্রিয়তা। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
🎬 সুচিত্রা-উত্তম জুটি: বাংলা রুপালি পর্দার সোনালি যুগ
উত্তমকুমারের নাম উচ্চারণ করলেই মনে পড়ে আরেক কিংবদন্তি—সুচিত্রা সেন। তাঁদের রসায়ন এমন ছিল যেন পর্দায় প্রেম বাস্তব মনে হতো। ‘সপ্তপদী’, ‘সাগরিকা’, ‘হারানো সুর’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘শাপমোচন’—এই ছবিগুলো শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যই নয়, শিল্পমানেও অনন্য।
তাঁদের সম্পর্কের সৌন্দর্য ছিল পর্দায়, বাস্তবে নয়—এটাই ছিল রহস্যময় ও মোহময়। সুচিত্রার সংযত সৌন্দর্য আর উত্তমের চটুল হাসি একত্রিত হয়ে তৈরি করেছিল এক চিরকালীন রোমান্টিক যুগল।
🎭 সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’: উত্তমকুমারের ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছানো
অনেকেই মনে করেন উত্তমকুমার শুধুই রোমান্টিক নায়ক ছিলেন। কিন্তু সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে। এখানে তিনি এক সুপারস্টারের ভূমিকায়, যে নিজের ভেতরের আত্মসংঘাত, একাকিত্ব ও সংশয়ের সঙ্গে লড়াই করে।
রায় তাঁর অভিনয়ের গভীরতা দেখে অভিভূত হন। এই ছবি ছিল উত্তমের ক্যারেক্টার অ্যাক্টিংয়ের এক অনন্য নিদর্শন। তাঁর অভিব্যক্তি, সংলাপহীন মুহূর্তগুলির গভীরতা আজও দর্শকদের মনে গাঁথা রয়েছে।
🎞️ হিন্দি ছবিতে চেষ্টা: ‘ছোটিসি মুলাকাত’
বাংলা ছবির গণ্ডি পেরিয়ে উত্তমকুমার হিন্দি সিনেমায়ও পা রাখেন। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় ‘ছোটিসি মুলাকাত’, যেটি তিনি নিজেই প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। যদিও ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি, তবুও এই চেষ্টায় তাঁর সাহস, আত্মবিশ্বাস ও নিজের পরিসর বাড়ানোর ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়।
📽️ পরিচালনার ক্ষেত্রেও দক্ষতা: ক্যামেরার পেছনের উত্তম
অনেকেই জানেন না, উত্তমকুমার ‘বনি’, ‘কালঙ্ক’, ‘ঝড়’, ‘রূপের রাণী’, ‘মায়ার সংসার’-এর মতো ছবিগুলির পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁর পরিচালনায় যেমন ছিল নাটকীয়তা, তেমনই ছিল বুদ্ধিদীপ্ত আবেগ।
তিনি চেয়েছিলেন শুধু পর্দার নায়ক নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে। এই আকাঙ্ক্ষাই তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রের একটি পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞায় রূপান্তরিত করে।
🏆 পুরস্কার ও স্বীকৃতি: কিংবদন্তির প্রাপ্য সম্মান
উত্তমকুমার ১৯৬৭ সালে ভারত সরকারের জাতীয় পুরস্কার পান ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ও ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ ছবিতে তাঁর অভিনয়ের জন্য। এছাড়া তিনি বহুবার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেতার সম্মান পেয়েছেন।
এই সম্মানগুলি শুধু পুরস্কার নয়, ছিল এক অসীম প্রেমের বহিঃপ্রকাশ, যা সময়ের সঙ্গে শুধু বেড়েছে।
❤️ বাঙালির ‘মনের মানুষ’: উত্তমকুমার একটি আবেগ
যাঁরা উত্তমকুমারকে পর্দায় দেখেছেন, তাঁরা জানেন, তিনি শুধু অভিনেতা ছিলেন না—একটা সময়, একটা মনোভাব। তাঁর চলাফেরা, হাসি, কণ্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি—সব কিছুতে ছিল এক অলিখিত আকর্ষণ।
তিনি ছিলেন বাঙালির আত্মপরিচয়ের অংশ। চুলে তেল দেওয়া পরিপাটি যুবক থেকে শুরু করে কলেজ পড়ুয়া তরুণ—সবাই একসময় উত্তম হতে চেয়েছে।
📺 সময়ের গহ্বরে উত্তম আজও জ্যোতির্ময়
আজ ৪৫ বছর কেটে গেছে, তবুও উত্তমকুমার রয়ে গেছেন বাঙালির স্মৃতিতে, কথায়, চিত্রনাট্যে, গানে। টেলিভিশনে যখনই তাঁর সিনেমা চলে, তরুণ থেকে বৃদ্ধ—সকলেই থমকে দাঁড়ান।
উত্তমকুমার আজও অমর, কারণ তিনি নিজের অভিনয় দিয়ে মানুষের মন জয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন—পর্দায়, হৃদয়ে, এবং বাংলার সংস্কৃতিতে।
📌 উপসংহার: উত্তম মানেই শ্রেষ্ঠত্ব, সৌন্দর্য আর সংস্কৃতির প্রতীক
বাংলা সিনেমায় অনেক নায়ক এসেছেন, গেছেন। কিন্তু উত্তমকুমার ছিলেন সেই অনন্য মহীরুহ, যার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে বাংলা সিনেমার ইতিহাস।
তাঁর অভিনয়, ব্যক্তিত্ব ও আত্মবিশ্বাস আজও শিক্ষণীয়। আমরা তাঁকে শুধুমাত্র স্মরণ করি না, তাঁর মধ্যেই বাঁচি—তাঁর ভালোবাসায়, সিনেমায়, সৌন্দর্যবোধে।