বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম এক চিত্র হলো জল কচুরিপানার ফুলে ভরা বিশাল জলাশয়। বর্ষার শেষে এবং শরতের শুরুতে যখন এই ফুলগুলো সাদা-বেগুনি রঙে দিগন্তজোড়া ছড়িয়ে পড়ে, তখন পুরো পরিবেশ যেন রূপকথার রাজ্যে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে রয়েছে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ও বাস্তব সমস্যা, যা বোঝা জরুরি।
আইচোর্নিয়া ক্র্যাসিপস (Eichhornia crassipes) নামের এই উদ্ভিদটির আদি নিবাস আমাজন অববাহিকা, দক্ষিণ আমেরিকা। ধারণা করা হয়, ১৮ শতকের শেষের দিকে ব্রাজিলের একজন ভ্রমণকারী এই ফুল বাংলায় নিয়ে আসেন। প্রথমদিকে আলংকারিক সৌন্দর্যের জন্য এই গাছ চাষ করা হলেও অল্প সময়েই এটি জলাশয়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
বাংলাদেশে একে অনেক অঞ্চলে ‘মেহেদি’ নামেও ডাকা হয়। বর্তমানে দেশের পুকুর, খাল, নদী, হাওর-বাঁওড় প্রায় সবখানেই এই উদ্ভিদের উপস্থিতি দেখা যায়।
জল কচুরিপানার রয়েছে ঘন, মোমের মতো ডিম্বাকৃতি পাতা, যা ৪-৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। এর কাণ্ডে থাকে বায়ুভর্তি টিস্যু, যা উদ্ভিদকে ভেসে থাকতে সাহায্য করে। ফুলের রঙ সাধারণত নীল-বেগুনি, প্রতিটি ফুলে থাকে ছয়টি পাপড়ি এবং একটি পাপড়িতে থাকে হলুদ দাগযুক্ত গাঢ় বেগুনি অংশ, যা ফুলের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার সময় এবং শরতের শুরুতে, বাংলাদেশের জলাশয়গুলোতে হাজার হাজার কচুরিপানার ফুল একসাথে ফুটে ওঠে। মহাসড়কের পাশের জলাশয়গুলোতে এই ফুল ফুটলে অনেক পথচারী গাড়ি থামিয়ে মুহূর্তটি ক্যামেরাবন্দি করেন।
ফটোগ্রাফার রিফাত-বিন-তাহা-এর ভাষায়, “যতবারই এই ফুল দেখি, ততবারই মুগ্ধ হই। তবে যখন পুরো জলাশয় একসাথে বেগুনি রঙে ঢেকে যায়, সেটি এক অনন্য অভিজ্ঞতা।”

যদিও জল কচুরিপানার ফুল মনোমুগ্ধকর, কিন্তু বাস্তবে এটি বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে আক্রমণাত্মক প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। এর দ্রুত বৃদ্ধির ক্ষমতা স্থানীয় জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।জলাশয়ের অক্সিজেন হ্রাস: ঘন কচুরিপানা সূর্যের আলো ও বাতাসকে জলে প্রবেশে বাধা দেয়, ফলে মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবনহানি ঘটে।নৌচলাচলে প্রতিবন্ধকতা: নদী বা খালে অতিরিক্ত কচুরিপানা নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়।কৃষি সেচে সমস্যা: জল সরবরাহ ব্যবস্থায় কচুরিপানা জমে পানি প্রবাহ কমিয়ে দেয়।
এক একর জমিতে প্রায় ৩৬০ মেট্রিক টন পর্যন্ত উদ্ভিদ জৈববস্তুপুঞ্জ উৎপন্ন করতে পারে। এ কারণে এটি জ্বালানি, পশুখাদ্য ও জৈবসারের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহারযোগ্য। তবে এর অতিরিক্ত বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়।
১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্সে Cotton States Exposition-এ আলংকারিক উদ্ভিদ হিসেবে এটি প্রথম প্রদর্শিত হয়। পরবর্তীতে অল্প সময়ে এটি দক্ষিণ যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা, এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া ও হাওয়াইতে এটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়।
যদিও কচুরিপানা অনেক সময় বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, তবুও গ্রামীণ জীবনে এর কিছু উপকারী দিক রয়েছে—পশুখাদ্য: গরু, ছাগলসহ গৃহপালিত পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।জৈবসার: পচিয়ে জৈবসার তৈরি করা যায়, যা কৃষিতে উপকারী।হস্তশিল্প: শুকনো কচুরিপানা দিয়ে ঝুড়ি, ম্যাট, ব্যাগসহ নানা পণ্য তৈরি হয়।জল পরিশোধন: গবেষণায় দেখা গেছে, এটি দূষিত পানি থেকে কিছু ক্ষতিকারক পদার্থ শোষণ করতে পারে।

জল কচুরিপানার অতিবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—যান্ত্রিক পদ্ধতি: বড় মেশিন বা নৌকার মাধ্যমে সরিয়ে ফেলা।জৈব নিয়ন্ত্রণ: বিশেষ ধরনের পোকা বা মাছ ব্যবহার করে এর বৃদ্ধি রোধ।জনসচেতনতা: গ্রামীণ এলাকায় এই উদ্ভিদ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বোঝানো।উপযোগী ব্যবহার: হস্তশিল্প, পশুখাদ্য বা জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগানো।
জল কচুরিপানার ফুল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অংশ। আমরা যদি সৌন্দর্য ও পরিবেশ সুরক্ষা—দুটিকেই সমান গুরুত্ব দিই, তবে এটি আমাদের জন্য শুধু একটি সমস্যাজনক উদ্ভিদ নয়, বরং একটি সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।
প্রকৃতি আমাদের উপহার দিয়েছে এই বেগুনি রঙের জল-গালিচা; আমাদের দায়িত্ব হলো, তা সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা।
✍️ তথ্যসংগ্রহ: রিফাত-বিন-ত্বহা | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ১১ আগস্ট ২০২৫