যশোরের সৈয়দ হাসনাইন মোহাম্মদ জুনেদ ছিলেন একজন গুণী ক্রিকেটার, যিনি তাঁর প্রতিভা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে যশোর থেকে শুরু করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ক্রিকেট অঙ্গন পর্যন্ত বিস্তৃত ছাপ রেখেছেন। তাঁর জন্ম ১৯৬৬ সালে, পিতা সৈয়দ নূর মোহাম্মদ, যিনি পেশায় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে কাজ করতেন। তাঁদের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া জেলায়। পরবর্তীতে পরিবারটি যশোর উপশহরে বসবাস শুরু করে, যেখানে সৈয়দ জুনেদের ক্রিকেট যাত্রার বীজ বপন হয়।
শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি
সৈয়দ হাসনাইন মোহাম্মদ জুনেদ চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ষষ্ঠ। এক বড় পরিবারে বেড়ে ওঠার ফলে শৃঙ্খলা ও একে অপরকে সহায়তার মানসিকতা তাঁর মধ্যে দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠে। পিতার চাকরি তাঁকে নিয়মানুবর্তিতা ও দায়িত্বশীলতার শিক্ষা দেয়।
শিক্ষাজীবন ও একাডেমিক কৃতিত্ব
শুধু মাঠেই নয়, একাডেমিক জীবনেও সৈয়দ জুনেদ ছিলেন অনন্য। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিনান্স বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা সত্ত্বেও পড়াশোনাকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন, যা তাঁর জীবনদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
যশোরের ক্রিকেটে পদার্পণ
যশোরের স্থানীয় ক্লাব ক্রিকেটের মধ্য দিয়েই জুনেদের ক্রিকেটজীবনের সূচনা। তিনি রাইজিং স্টার ক্লাব ও ইলেভেন ষ্টার ক্লাব এর হয়ে বহু ম্যাচ খেলেন। তাঁর বোলিং দক্ষতা খুব অল্প সময়ের মধ্যে সবার নজরে আসে। কঠোর পরিশ্রম আর নিয়মিত অনুশীলন তাঁকে যশোরের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড়ে পরিণত করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেট
ঢাকায় পড়াশোনা চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট টিমে তাঁর বোলিং ছিল প্রতিপক্ষের আতঙ্ক। বিশ্ববিদ্যালয় লিগে তিনি একের পর এক ম্যাচ জেতানোর মত পারফরম্যান্স দেন। এরপরই তাঁর নাম ঢাকার শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ পথচলা
সূর্য তরুণ ক্লাব, মোহামেডান ক্লাব, আবাহনী লিঃ, রূপালী ব্যাংক, চট্টগ্রামের ষ্টার ক্লাব, আবাহনী লিঃ, আগ্রাবাদ নওজোয়ান – এ সকল ক্লাবে খেলেছেন সৈয়দ জুনেদ। তাঁর বোলিং একদিকে যেমন ধারালো ছিল, অন্যদিকে দলকে প্রয়োজনীয় সময়ে ব্রেকথ্রু এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আস্থার প্রতীক।
বোলিং দক্ষতা ও খেলার বৈশিষ্ট্য
তিনি মূলত ফাস্ট বোলার ছিলেন, যার বোলিং স্পিড এবং লাইন-লেন্থ ছিল অসাধারণ। তাঁর বলের সুইং ও পিচ রিডিং ক্ষমতা তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছিল। সতীর্থ ও প্রতিপক্ষ উভয়ই জানতেন, সৈয়দ জুনেদ থাকলে প্রতিটি ওভারেই উইকেটের সম্ভাবনা থাকবেই।
চোটের কারণে আকস্মিক অবসর
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এক সময় পায়ে আঘাত পেয়ে সৈয়দ জুনেদকে ক্রিকেট থেকে অবসর নিতে হয়। খেলোয়াড়ি জীবনের মাঝপথে এই চোট তাঁর স্বপ্নগুলোকে কিছুটা থামিয়ে দেয়। তবুও তিনি ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে থেকে গেছেন একজন যোগ্য খেলোয়াড় হিসেবে।
অবসরের পরের জীবন
অবসরের পর সৈয়দ জুনেদ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর একাডেমিক যোগ্যতা এবং সততা তাঁকে ব্যবসায়িক জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে। যদিও তিনি মাঠে আর বল হাতে নামেননি, তবুও তাঁর অভিজ্ঞতা ও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা আজও নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।
যশোরের ক্রিকেটে সৈয়দ জুনেদের অবদান
যশোরে ক্রিকেটের বিকাশে সৈয়দ জুনেদ ছিলেন অগ্রণী ভূমিকার অধিকারী। তিনি ক্লাবগুলোতে তরুণ খেলোয়াড়দের দীক্ষা দিতেন, কীভাবে বোলিং করতে হবে, ফিল্ডিং সাজাতে হবে, এগুলো হাতে-কলমে শেখাতেন। অনেকেই আজ তারই দেখানো পথে এগিয়ে গিয়ে বড় দলগুলোতে খেলছেন।
তাঁর থেকে শেখার বিষয়সমূহ
- শৃঙ্খলা: প্রতিদিন অনুশীলন, ডায়েট, বিশ্রাম—সব কিছুতে কঠোর নিয়ম।
- দায়িত্ববোধ: দলের প্রয়োজনে সর্বোচ্চ দিতে প্রস্তুত থাকা।
- শিক্ষার গুরুত্ব: খেলার পাশাপাশি পড়াশোনায় মনোযোগী থাকা।
- পরিশ্রমের বিকল্প নেই: মাঠে দীর্ঘ সময় কঠোর অনুশীলনই তাঁর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।
যশোরের ক্রীড়াঙ্গনে অনুপ্রেরণার বাতিঘর
আজকের দিনে সৈয়দ হাসনাইন মোহাম্মদ জুনেদ প্রমাণ করে গেছেন, প্রতিকূলতাকে পাশে রেখে কীভাবে একজন খেলোয়াড় ও মানুষ হিসেবে সফল হওয়া যায়। তাঁর গল্প নতুন প্রজন্মের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
উপসংহার
একজন ক্রিকেটার, একজন শিক্ষিত ব্যক্তি, একজন উদ্যোক্তা এবং সর্বোপরি একজন প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সৈয়দ হাসনাইন মোহাম্মদ জুনেদ আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তাঁর খেলোয়াড়ি জীবন, কঠোর পরিশ্রম ও অসাধারণ মানসিক শক্তি আজও যশোরসহ সারাদেশের তরুণদের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে রাখে।