কাঁঠাল: স্বাদে মধু, বিপদে বিষ
আমরা সকলেই জানি, কাঁঠাল আমাদের দেশের অন্যতম প্রিয় ও পুষ্টিকর ফল। গ্রীষ্মকালে বাজারে কাঁঠালের গন্ধেই মন ভরে ওঠে। কিন্তু এই মিষ্টি ফলই যে কিছু সরকারি বাসচালককে এমন বিপাকে ফেলবে, তা সত্যিই অভাবনীয়।
বাসচালকদের নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা
প্রতিদিনের মতোই কেরালার পাথানামথিত্তার এক সরকারি বাসডিপোতে একদল চালক রাত্রি যাপন করছিলেন। পরদিন সকালে তাঁদের বাস চালানোর আগে রুটিন অ্যালকোহল টেস্ট দিতে হয়। এই পরীক্ষা চালকদের দায়িত্বশীলতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মদ্যপান অবস্থায় বাস চালানো যে কতটা বিপজ্জনক, তা নতুন করে বলার কিছু নেই।
যন্ত্রের রিপোর্টে চাঞ্চল্য
যখন পরীক্ষা করা হয়, তখন দেখা যায় বেশ কয়েকজন চালকের রিপোর্টে মদ্যপানের মাত্রা সীমার বাইরে। স্বাভাবিকভাবেই, এ রিপোর্ট দেখে তাজ্জব হয়ে যান তাঁরা। কারণ তাঁদের দাবি, কেউই মদ স্পর্শও করেননি।
কাঁঠাল খাওয়া কীভাবে দায়ী?
অফিসারদের প্রশ্নে এক চালক জানান, রাতে তাঁদের এক সহকর্মীর আনা কাঁঠাল সবাই মিলে ভাগ করে খেয়েছিলেন। তখনই তৈরি হয় প্রশ্ন – ফল খেলে কীভাবে অ্যালকোহল টেস্ট পজিটিভ হয়? এ প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তৎক্ষণাৎ এক নতুন পরীক্ষা চালানো হয়।
পরীক্ষা: সন্দেহের অবসান
ডিপোর এক কর্মী, যিনি কাঁঠাল খাননি ও মদ্যপানও করেননি, তাঁকে প্রথমে টেস্ট করা হয়। রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। এরপর তাঁকে কাঁঠাল খেতে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ বাদে ফের পরীক্ষা – এবার রিপোর্টে মদ্যপানের উপস্থিতি! তাতেই পরিষ্কার হয় যে কাঁঠাল খাওয়ার পরই শরীরে কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে, যা যন্ত্রে অ্যালকোহল হিসেবে ধরা পড়ছে।
কাঁঠালের রাসায়নিক গুণাগুণ
কাঁঠালে থাকে ফ্রুক্টোজ, গ্লুকোজ সহ নানান প্রাকৃতিক শর্করা। দীর্ঘক্ষণ পাকা অবস্থায় রাখলে বা পেটের ভেতর গিয়ে কিছু শর্করা গাঁজন (Fermentation) প্রক্রিয়ায় অ্যালকোহলে রূপান্তরিত হয়। ফলে শ্বাস পরীক্ষা যন্ত্রে সেটি অ্যালকোহল হিসেবেই ধরা পড়ে।
অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত
এই পরীক্ষার পর স্পষ্ট হয় যে, চালকরা মিথ্যা বলেননি। তাঁদের শরীরে যে অ্যালকোহল ধরা পড়েছে তা কৃত্রিম নয়, বরং প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন। ফলে তাঁদের উপর থেকে ভুল অভিযোগের বোঝা সরে যায়।
প্রশাসনের সিদ্ধান্ত
এরপর ডিপো কর্তৃপক্ষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, শুধু যন্ত্রের রিপোর্ট নয়, সন্দেহজনক ফলাফলের ক্ষেত্রে পুনঃপরীক্ষা ও অন্য কোনও প্রমাণ যাচাই করা হবে। এমন ঘটনা যে অন্যত্রও ঘটতে পারে, তা মাথায় রেখে সব ডিপোতে গাইডলাইন পাঠানো হয়।
অভিভাবকতুল্য দায়িত্ববোধ
একজন চালক শুধু গাড়ি চালান না, তিনি প্রতিটি যাত্রীর জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্বও বহন করেন। তাই এই নিরীক্ষা প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এক্ষেত্রে দেখা গেল, শুধু প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা কখনও কখনও অন্যায়ভাবে নির্দোষকে দোষী প্রমাণ করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মত
পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কিছু নির্দিষ্ট ফল যেমন কাঁঠাল, আনারস ইত্যাদি বেশি পেকে গেলে বা বেশি সময় পেটে থাকলে সেগুলি গাঁজিত হয়ে সামান্য মাত্রায় অ্যালকোহল উৎপন্ন করতে পারে। যন্ত্রে সেই মাত্রাই ধরা পড়ে। যদিও এ অ্যালকোহল মানবশরীরের পক্ষে ক্ষতিকর নয়, তবুও যন্ত্রের কাছে তা অ্যালকোহল হিসেবেই ধরা দেয়।
জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি
এ ঘটনার পর সাধারণ মানুষের মাঝেও কাঁঠাল ও অনুরূপ ফল খাওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত এতে বড় কোনও সমস্যা নেই। তবে যারা অ্যালকোহল টেস্টের আওতায় পড়েন, তাঁদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। যেমন ড্রাইভার, পাইলট, নিরাপত্তা রক্ষী ইত্যাদি পেশার মানুষদের নির্দিষ্ট সময়ে এমন ফল এড়িয়ে চলা ভালো।
পরিষ্কার নীতি ও সঠিক পরীক্ষা
এ ধরনের বিভ্রান্তি এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও উন্নত অ্যালকোহল টেস্টিং পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে মানবিক বোধ। সন্দেহজনক ফলাফলের ক্ষেত্রে পুনঃপরীক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
পথ চলতে শৃঙ্খলা বজায় রাখি
বাসচালকেরা আমাদের শহর, জেলা ও রাজ্য জুড়ে জীবনের স্পন্দন বইয়ে রাখেন। তাঁদের দায়িত্বে সামান্যতম অবহেলা মানে হাজারো মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়া। তাই তাঁদের উপর সন্দেহ হলেও তা বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাই করাই কর্তব্য।
শেষ কথা
কাঁঠাল খাওয়ার জের নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে মানবিক যুক্তি। অদূর ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে নিয়মিত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক গাইডলাইন প্রণয়ন ও সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া হবে – এমনটাই সকলের প্রত্যাশা।