মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পাহাড়ি টিলাভূমিতে জাম্বুরা চাষের ইতিহাস বহু পুরনো। তবে এবার কৃষি বিভাগ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে স্থানীয়ভাবে পাওয়া গেছে আরও ১২টি উন্নত জাতের জাম্বুরা, যার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ বীজহীন। কৃষিবিদরা মনে করছেন, এসব উন্নত জাত বাণিজ্যিকভাবে কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে।
১২টি উন্নত জাম্বুরার চিহ্নিতকরণ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ দল সম্প্রতি মাঠ পর্যায়ে গবেষণা চালিয়ে রং, মিষ্টতা, পাল্পের গুণমান ও রসের পরিমাণের ভিত্তিতে ১২টি জাতকে উন্নত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে একটি জাতকে বীজহীন পাওয়া গেছে, যা বাজারে বিশেষ চাহিদা তৈরি করবে।
এখনই দুটি উন্নত জাতকে কলম পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো কুলাউড়া উপজেলার হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে দ্রুত কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। পাশাপাশি প্রদর্শনী প্লটও করা হবে, যাতে কৃষকরা সরাসরি উন্নত জাতের ফলন দেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
জুড়ীর টিলাভূমিতে জাম্বুরার ঐতিহ্য
জুড়ী উপজেলায় প্রাচীনকাল থেকেই জাম্বুরা চাষ হয়ে আসছে। বর্তমানে প্রায় ৬৬ হেক্টর জমিতে জাম্বুরার আবাদ হচ্ছে, যার মধ্যে গোয়ালবাড়ী ও পূর্ব জুড়ী ইউনিয়ন অগ্রগণ্য। প্রতিবছর প্রায় ১২ টন জাম্বুরা উৎপাদন হলেও আদিম জাতের কারণে কৃষকরা লাভবান হতে পারছিলেন না।
বীজ থেকে উৎপন্ন চারা বিভিন্ন বৈচিত্র্য তৈরি করে, ফলে ফলনের মান ও দাম একরকম থাকে না। কৃষি বিভাগের উদ্যোগে এবার কৃষকরা একজাতীয় উন্নত চারা পাবেন, যা বাজারজাতকরণ ও লাভজনক উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখবে।
‘জুড়ী বাতাবিলেবু-১’ ও ‘জুড়ী বাতাবিলেবু-২’: দেশের সাফল্য
এর আগে ২০২২ সালে ‘লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদনবৃদ্ধি প্রকল্পের’ আওতায় জুড়ীর দুটি জাতকে— জুড়ী বাতাবিলেবু-১ ও জুড়ী বাতাবিলেবু-২—উন্নত হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। কলম পদ্ধতিতে উৎপাদিত প্রায় ৪ হাজার চারা দেশের ১২৭ উপজেলায় বিতরণ করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে এসব জাত বাজারে ভালো সাড়া ফেলেছে।
সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে নতুন আরও ১২টি জাতের সন্ধান পাওয়া কৃষি বিভাগকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
কৃষকের প্রত্যাশা ও নতুন দিগন্ত
স্থানীয় কৃষক সুরুজ আলী, আবদুল মান্নান ও ছুরকুম আলী জানান, তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জাম্বুরা চাষ করে আসছেন। তবে উন্নত জাত সম্পর্কে আগে কোনো ধারণা ছিল না। বর্তমানে প্রতিটি জাম্বুরা মাত্র ৪–৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। উন্নত জাতের চারা পেলে তারা ব্যাপকভাবে জাম্বুরা চাষে ঝুঁকবেন এবং ভালো দাম পাওয়ার আশাবাদী।
কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল আলম খান বলেন, একসময় কমলা চাষে জুড়ীর সুনাম ছিল। কিন্তু রোগবালাই ও বাজারজাতকরণের সমস্যায় কমলার আবাদ কমে যায়। এখন জাম্বুরা চাষে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, জুড়ীর জাম্বুরা কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়, যা একে সম্পূর্ণ বিষমুক্ত করে তুলেছে।
জাম্বুরার পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
জাম্বুরা শুধু সুস্বাদুই নয়, বরং স্বাস্থ্য উপকারিতায় ভরপুর।এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।বিটা ক্যারোটিন ও ভিটামিন বি চোখ ও ত্বকের জন্য উপকারী।লিমোনোয়েড নামক যৌগ ক্যানসারের জীবাণু ধ্বংসে ভূমিকা রাখে।এর রস শরীরের অতিরিক্ত চর্বি ভেঙে ওজন কমাতে সাহায্য করে।গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী।
জাতীয় বাজারে জুড়ীর জাম্বুরার সম্ভাবনা
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জাম্বুরা ঢাকা ও দেশের অন্যান্য পাইকারি বাজারে যায়। তবে উন্নত জাত বাজারে আসলে এর দাম বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষকের আয় বহুগুণে বাড়বে।
উৎসব মৌসুমে জাম্বুরার চাহিদা বাড়ে। বিশেষ করে দুর্গাপূজায় এ ফলের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। তাই উন্নত ও বীজহীন জাত বাজারজাত করা গেলে কৃষকরা মৌসুমি লাভের পাশাপাশি সারা বছর আয় করতে পারবেন।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জুড়ীর নতুন আবিষ্কৃত ১২টি জাম্বুরা জাত সারা দেশে প্রসারিত হলে বাংলাদেশে জাম্বুরা চাষের এক নতুন যুগ শুরু হবে। উন্নত জাতের বীজহীন জাম্বুরা আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি করবে।
জাম্বুরা এখন আর শুধু স্থানীয় ফল নয়; এটি কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে পারে।
👉 সংক্ষেপে:
জুড়ীতে আবিষ্কৃত নতুন ১২টি জাম্বুরা জাত, বিশেষ করে বীজহীন জাত, কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে। উন্নত জাতের চারা কৃষকদের হাতে পৌঁছালে বাড়বে উৎপাদন, বাড়বে আয়ের সুযোগ। আর জুড়ীর জাম্বুরা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে একসময় আন্তর্জাতিক বাজারেও জায়গা করে নেবে—এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয় কৃষক ও কৃষিবিদদের।