জন্ম ও পারিবারিক পটভূমি
এ এফ এম মঈনুদ্দীন রোম, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এক উজ্জ্বল নাম, যাঁর জন্ম ১৯৬৪ সালের ৩ মার্চ যশোর শহরের খড়কী এলাকায়। পিতা ছিলেন অধ্যক্ষ আব্দুল হাই, যিনি একজন শিক্ষানুরাগী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। রোমের পিতৃব্য আবদুল হক ছিলেন একজন খ্যাতনামা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ছয় ভাই ও চার বোনের পরিবারে রোম ছিলেন নবম সন্তান।
শিক্ষা ও প্রারম্ভিক জীবন
শিক্ষাজীবনে তিনি এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি অগাধ আগ্রহ ছিল। স্কুলজীবনে যশোরের মাঠে নিয়মিত খেলতেন এবং প্রতিভার ঝলক দেখাতে শুরু করেন খুব অল্প বয়সেই।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরু: ডায়মণ্ড ক্লাব ও যশোরের জয়যাত্রা
১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে রোমের ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয় “ডায়মণ্ড ক্লাব”-এ, যেখানে তিনি লীগ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি যশোরের জনপ্রিয় ক্লাবগুলোর হয়ে খেলেছেন, যেমন:
- এম এম কলেজ
- শহীদ স্মৃতি সংঘ
- আর এন রোড
- রাইজিং স্টার
- সৃজনী সংসদ (ঘোপ)
অন্যান্য ক্লাব ও জেলা পর্যায়ের সাফল্য
খুলনায় তিনি খেলেছেন—
- ভেনাস স্পোর্টিং
- মৌসুমী ক্লাব
- ওয়াণ্ডারার্স
- প্যাগাসাস
রাজশাহীতে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ খেলা ছিল—
- বৈকালী সংঘ
- কাজী হাটা টাউন ক্লাব
এছাড়া ফরিদপুর এবং গোয়াল চামট লীগেও অংশ নিয়েছেন।
সেঞ্চুরি, রানের বন্যা ও স্মরণীয় পারফর্ম্যান্স
- যশোর লীগে ৭টি সেঞ্চুরি করেন এবং একাধিকবার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন।
- স্বপন স্মৃতি টুর্নামেন্টে করেন ৩টি সেঞ্চুরি।
- বেজপাড়া ছাত্র সংঘের হয়ে খেলতে গিয়ে করেন ১৮৯ রান নটআউট — যশোর ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা ইনিংস।
- রাজশাহী লীগে তাঁর ছিল ২টি সেঞ্চুরি।
ঢাকা লীগ ও জাতীয় পর্যায়ের সাফল্য
ঢাকা শহরের শক্তিশালী দলগুলোর হয়ে দীর্ঘ এক যুগ খেলেছেন—
- ওয়াণ্ডারার্স ক্লাব (১৯৭৯-৮০)
- অগ্রণী ব্যাংক (১৯৮০-১৯৮৫)
- ভিক্টোরিয়া ক্লাব (১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৮-৯০) — এখানে তিনি অধিনায়ক ছিলেন।
- বিমান ক্লাব (১৯৯০-১৯৯১)
- লালমাটিয়া ক্লাব (১৯৯২-১৯৯৪) — অধিনায়কত্ব পালন করেন।
- গুলশান ইয়থ (১৯৯১-১৯৯২)
১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে ঢাকা লীগে ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক — ৬২০ রান এবং নিয়েছিলেন ২০টি উইকেট।
জাতীয় দলে ডাক ও জাতীয় লীগে অংশগ্রহণ
- দুইবার বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে ডাক পান।
- ১৬ বছর ধরে জাতীয় ক্রিকেট লীগে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন — এটি রোমের ক্যারিয়ারের অন্যতম দীর্ঘ ও সম্মানজনক অধ্যায়।
অধিনায়কত্ব ও কোচিং অভিজ্ঞতা
- যশোর জেলা দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত।
- যুবদলে দুইবার ও জেলা দলে তিনবার অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন।
- ক্রিকেট কোচ হিসেবেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য — যুবদল ও জেলা দলকে নিয়ে চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছান একাধিকবার।
- ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ রানার্সআপ লাভ করে, তাতে রোমের কোচিংয়ের প্রভাব ছিল অসাধারণ।
ম্যানেজমেন্ট ও ক্রিকেট প্রশাসনে অংশগ্রহণ
- প্রথম জাতীয় ক্রিকেট লীগে খুলনা বিভাগীয় দলের সহকারী ম্যানেজার।
- দ্বিতীয় জাতীয় লীগে খুলনার কোচ হিসেবে চূড়ান্ত পর্বে দলের জায়গা নিশ্চিত করেন।
- যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থা’র ক্রিকেট উপপরিষদের যুগ্ম সম্পাদক।
- যশোর আম্পায়ার অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
শহীদ আসাদ ক্রিকেট ক্লিনিক ও কোচিং প্রশিক্ষণ
২০০১ সালে রোম “শহীদ আসাদ ক্রিকেট ক্লিনিক” পরিচালনার দায়িত্ব পান এবং একই বছর শ্রীলঙ্কার কোচের অধীনে কোচিং লেভেল কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আধুনিক ক্রিকেট কোচে পরিণত হন।
দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স: যশোর বনাম খুলনা
- ১৯৮১-৮২ মৌসুমে খুলনার বিরুদ্ধে ২৭ রানে ৭ উইকেট নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
- ১৯৯১ সালে জোনাল ফাইনালে ৯১ রান নটআউট ইনিংস খেলেন, যা তাঁকে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পুরস্কার এনে দেয়।
আসাদ স্মৃতি ক্রিকেট কোচিং সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা
২০০১ সালে তিনি ছিলেন “আসাদ স্মৃতি ক্রিকেট কোচিং সেন্টার”-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। যশোরের তরুণ ক্রিকেটার তৈরির কারিগর হিসেবে এই কেন্দ্র একটি স্মারক হয়ে আছে।
উপসংহার: যশোরের রত্ন, বাংলাদেশের গর্ব
এ এফ এম মঈনুদ্দীন রোম শুধুমাত্র একজন সফল ক্রিকেটারই নন, তিনি একাধারে অভিনব অধিনায়ক, দক্ষ কোচ, সফল সংগঠক ও অনুপ্রেরণার প্রতীক। তাঁর ক্রিকেট-জীবন আগামী প্রজন্মের ক্রীড়াবিদদের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর।