বাংলাদেশের ফুটবল ও হকির ইতিহাসে যে কয়েকজন কৃতি ক্রীড়াবিদ নিজেদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন, তাদের মধ্যে তাজ হোসেন তাজ অন্যতম। তিনি শুধু একজন ফুটবল ও হকি খেলোয়াড়ই নন, বরং কোচ, রেফারি এবং ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ক্রীড়ার প্রতি নিবেদন, পরিশ্রম এবং সাফল্যের গল্প বহন করে।
১৯৪৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন তাজ হোসেন তাজ। পিতার চাকরিসূত্রে পরিবারের স্থায়ী নিবাস গড়ে ওঠে যশোর উপশহরে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তাজ ছিলেন সবার ছোট। তাঁর বড় ভাই শেখ আলতাফ হোসেন ছিলেন একজন কৃতি ফুটবল খেলোয়াড়, যিনি তাজের খেলাধুলার জীবনে অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনে তিনি এসএসসি পাশ করেন, তবে খেলার প্রতি আগ্রহ তাঁকে পেশাগত জীবনে ভিন্ন এক পথে নিয়ে যায়।
তাজ হোসেন তাজের ক্রীড়াজীবন শুরু হয় ১৯৫৮ সালে যশোর পুলিশ লাইন মাঠ থেকে। এখানেই তিনি ফুটবল এবং হকিতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। হকিতে তাঁর প্রথম গুরু ছিলেন পুলিশের খেলোয়াড় ইব্রাহিম সাহেব এবং রেজাউল সাহেব। ফুটবলে দীক্ষা নেন বড় ভাই শেখ আলতাফ হোসেন এবং ভগ্নিপতি শাহাজাহান আলীর কাছ থেকে, যিনি নিজেও একজন প্রাক্তন ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন।
১৯৬৩ সাল থেকে তাজ হোসেন তাজ ঢাকার প্রথম বিভাগ হকি ও ফুটবল লিগে খেলতে শুরু করেন। একই বছরে তিনি যশোর জেলা দলের হয়ে আন্তঃজেলা ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ১৯৬৪ সাল থেকে খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া এবং ফরিদপুর জেলার ফুটবল লীগে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে নিজেকে প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
খেলোয়াড় জীবনের মাঝপথে এক দুঃখজনক ঘটনার সম্মুখীন হন তাজ হোসেন তাজ। যশোর স্টেডিয়ামে কালেক্টরেট টিমের হয়ে খেলার সময় তাঁর বাঁ পা ভেঙে যায়। তবে তিনি হাল ছাড়েননি। ১৯৬৬ সালে পুনরায় ঢাকার প্রথম বিভাগে “ওয়ারী ক্লাব” এবং “ভিক্টোরিয়া ক্লাব”-এর হয়ে ফুটবল ও হকিতে নিয়মিত খেলায় অংশগ্রহণ শুরু করেন। এই সময়েই তিনি পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে লাহোর ও রাওয়ালপিণ্ডিতে হকি খেলেন এবং ফুটবলে যশোর স্টেডিয়ামে ইরানের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পান।
১৯৬৯ সালে খেলোয়াড় হিসাবে “বি জি প্রেস”-এ যোগ দেন তাজ হোসেন তাজ। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি বি জি প্রেসের ফুটবল দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন। এছাড়াও ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে “বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দলে” (২য় বিভাগ) দুই বছর খেলেছেন। এর পাশাপাশি তিনি টাঙ্গাইল জেলা দলের হয়ে তিনবার জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ হকি দলের পক্ষে তিনি ভারতের নিউ দিল্লিতে নেহেরু কাপ হকি টুর্নামেন্টে অংশ নেন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি “ওয়ারী ক্লাব”-এর হয়ে নিয়মিত হকি খেলোয়াড় হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। এর বাইরে তিনি যশোর জেলার হয়ে চারবার আন্তঃজেলা ফুটবল খেলেছেন এবং জাতীয় হকি খেলায় ছয় থেকে সাতবার অংশ নিয়েছেন। তাজ হোসেন তাজ তিনবার হকি দলের ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করেন।
খেলোয়াড় জীবনের পাশাপাশি তাজ হোসেন তাজ একজন দক্ষ কোচ ও রেফারি হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি “ওয়ারী ক্লাব”-এর হকি প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি ঢাকায় নিয়মিত হকি খেলায় আম্পায়ারিং করেন। ফুটবলের প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ লীগে প্রায় চার বছর রেফারি হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের লাহোরে সাফ আয়োজিত আম্পায়ারিং প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালে তিনি জাতীয় ‘এ’ গ্রেড আম্পায়ার হিসেবে প্রমোশন পান।
১৯৮০ সালে তাজ হোসেন তাজ আনুষ্ঠানিকভাবে খেলোয়াড় জীবন থেকে অবসর নেন। তবে অবসর নেওয়ার পরও তিনি কোচিং, রেফারিং এবং ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেশের ফুটবল ও হকির উন্নয়নে অবদান রেখে গেছেন।
তাজ হোসেন তাজের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে প্রেরণাদায়ক উদাহরণ। খেলোয়াড়, কোচ, রেফারি, আম্পায়ার এবং ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তাঁর অবদান অনন্য। যশোর থেকে শুরু করে ঢাকার ক্রীড়াঙ্গন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত তিনি যেভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা পরবর্তী প্রজন্মের খেলোয়াড়দের জন্য এক অনুকরণীয় প্রেরণা হয়ে থাকবে।
✍️ জীবনী ও তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ০২-সেপ্টেম্ববর ২০২৫