গ্রাম মানেই সহজ-সরল জীবন, মাটির গন্ধ আর চিরচেনা সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যের অংশ হয়ে আছে প্রাচীন এক পেশা—নরসুন্দরের সেলুন। গাছতলার সেলুন শুধু চুল-দাড়ি কাটার জায়গা নয়, এটি গ্রামীণ সংস্কৃতির জীবন্ত প্রতীক। আজও দেশের আনাচে-কানাচে হাট-বাজারে, পুকুরপাড়ে বা কোনো বটগাছের ছায়ায় দেখা মেলে কাঠের পিড়ির উপর বসা নাপিতদের। পাশে থাকে একটি আয়না, কলস ভর্তি পানি আর হাতে পুরোনো ক্ষৌর। মুখে বয়সের ছাপ, গায়ে দারিদ্র্যের চিহ্ন, তবু চোখে ভরসা আর টিকে থাকার দৃঢ় সংকল্প।
বর্তমান সময়ে শহরের চাকচিক্যময় সেলুন সংস্কৃতি ধীরে ধীরে গ্রামেও প্রবেশ করেছে। রঙিন আলো, আরামদায়ক চেয়ার, উন্নতমানের যন্ত্রপাতি আর চটকদার বিজ্ঞাপনে ভরপুর এসব আধুনিক সেলুন। এর ফলে গ্রামীণ গাছতলার সেলুনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। তবু আশ্চর্যজনকভাবে গ্রামের সাধারণ মানুষ এখনো আস্থা রাখে এই ঐতিহ্যবাহী সেলুনগুলোর উপর। হাঁটুর কাছে মাথা রেখে বসে চুল কাটতে দেন, কারণ এখানে রয়েছে বিশ্বাস, দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক আর সহজলভ্যতা।
নরসুন্দর বা স্থানীয় ভাষায় যাদের বলা হয় নাপিত বা পরামানিক, তারা একসময় গ্রামীণ সমাজে অপরিহার্য ছিলেন। শুধু চুল-দাড়ি কাটাই নয়, সামাজিক বার্তাবাহকের ভূমিকাও পালন করতেন তারা।বিয়ে, অন্নপ্রাশন, নামকরণসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে ডাকা ছিল তাদের দায়িত্ব।গ্রামে কোনো খবর ছড়িয়ে দেওয়া কিংবা মানুষের মধ্যে বার্তা পৌঁছে দেওয়ায় তাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।গ্রামীণ প্রবচনেই বলা হতো—“নাপিত ছাড়া কোনো আয়োজন পূর্ণ হয় না।” আজ যদিও সেই অবস্থান অনেকটা সংকুচিত, তবু তাদের অবদান ইতিহাসে অমলিন হয়ে আছে।গাছতলার সেলুন শুধু চুল-দাড়ি কাটার জায়গা নয়, এটি হয়ে উঠেছে সামাজিক আড্ডার কেন্দ্র। ক্ষৌরের শব্দের সাথে সাথে জমে ওঠে নানা আলোচনা। রাজনীতি, ক্রিকেট, বাজারদর, হাটের খবর—সবকিছু নিয়েই চলে প্রাণবন্ত কথোপকথন। ফলে এই সেলুনগুলো গ্রামীণ সম্পর্ক দৃঢ় করার এক অনন্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
নরসুন্দরের পেশা কখনোই খুব লাভজনক ছিল না। আধুনিক সেলুনের প্রতিযোগিতায় তাদের আয়-রোজগার আরও সীমিত হয়ে পড়ছে। তবু অনেক নাপিত এখনো বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন। কারণ এটি শুধু একটি পেশা নয়, বরং এক ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। তাদের চোখেমুখে দারিদ্র্যের ছাপ থাকলেও মনোজগতে আছে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছাশক্তি।
আধুনিকতার জোয়ার একদিন হয়তো গাছতলার সেলুনকে বিরল দৃশ্যে পরিণত করবে। তবে যতদিন গ্রামীণ মানুষ সরলতা ও আন্তরিকতায় বাঁচতে চাইবে, ততদিন বটগাছের ছায়ায় কাঠের পিড়িতে বসে ক্ষৌরের শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাবে। নরসুন্দরের এই সংগ্রামী টিকে থাকা মানে আসলে গ্রামীণ ঐতিহ্যের টিকে থাকা।
গাছতলার সেলুন কেবল একটি চুল কাটার স্থান নয়; এটি একটি সংস্কৃতি, একটি ইতিহাস আর গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। এখানে মিশে আছে বিশ্বাস, সামাজিক বন্ধন, হাসি-আড্ডা আর ঐতিহ্যের অমূল্য ধারাবাহিকতা। তাই নরসুন্দরের টিকে থাকার গল্প আসলে গ্রামীণ জীবনের সংগ্রাম ও সৌন্দর্যের গল্প।
✍️ জীবনী ও তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ০২-সেপ্টেম্ববর ২০২৫