ইজিবাইক চালক আল আমিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যশোরের আদালতে দেওয়া রায় আজ দেশের বিচার ব্যবস্থার একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। অপরাধ, তদন্ত, চার্জশিট এবং চূড়ান্ত রায়—পুরো প্রক্রিয়াটি যেভাবে সংঘটিত হয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট যে বিচার বিভাগ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ছাড় দেয়নি। এই প্রতিবেদনে আমরা ঘটনার শুরু থেকে রায় পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় বিশদভাবে উপস্থাপন করছি।
হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট: মাগুরার হরিশপুর গ্রামের এক সাধারণ দিনমজুরের মর্মান্তিক পরিণতি
আল আমিন, মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার হরিশপুর গ্রামের বাসিন্দা, পেশায় একজন ইজিবাইক চালক ছিলেন। জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনের মতো ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ইজিবাইক নিয়ে। তবে রাত গড়িয়ে গেলেও আল আমিন আর ফেরেননি।
পরিবার থেকে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এই নিখোঁজ হওয়া পরে এক ভয়ানক খবরের দিকে নিয়ে যায়, যা পুরো হরিশপুর অঞ্চল এবং দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
আল আমিনের মরদেহ উদ্ধার: একটি চাঞ্চল্যকর সন্ধান
পরদিন, ১০ ডিসেম্বর দুপুরে স্থানীয়দের মাধ্যমে পাওয়া খবর অনুযায়ী, যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার বুধোপুর গ্রামের রাস্তার পাশে একজন অজ্ঞাতনামা যুবকের মরদেহ দেখতে পান স্থানীয় লোকজন। পুলিশকে খবর দেওয়া হলে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় চাঁচড়া ফাঁড়ির পুলিশ, এবং মৃতদেহটি শনাক্ত করে ইজিবাইক চালক আল আমিন হিসেবে।পুলিশ একই সময় আল আমিনের ব্যবহৃত ইজিবাইকটি উদ্ধার করে, যেটি অপরাধীদের দ্বারা ছিনতাই হয়েছিল।
হত্যা মামলা দায়ের ও তদন্ত প্রক্রিয়া
১১ ডিসেম্বর আল আমিনের পিতা মোস্তাফিজুর রহমান, বাঘারপাড়া থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর র্যাব ও থানা পুলিশ যৌথভাবে তদন্তে নামে এবং ২৫ ডিসেম্বর চারজনকে আটক করে।
আটককৃতরা হলো: জুয়েল খান, রামপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর খানের পুত্র,হারুন অর রশীদ, সেলিম হোসেনের পুত্র,আল আমিন, হযরত আলীর পুত্র,রাসেল মোল্যা, পিরোজপুরের সুলতান মল্লিকের পুত্র
চার্জশিট ও তদন্ত প্রতিবেদন: অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র
তদন্তে উঠে আসে, হত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইজিবাইকটি ছিনতাই করা। মূল তিন আসামি—জুয়েল, হারুন ও আলামিন—এই পরিকল্পনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন। অপরদিকে, রাসেল মোল্যা চোরাই ইজিবাইক ক্রয়ের অপরাধে অভিযুক্ত হন।
১৪ ডিসেম্বর ২০২২, তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই হরষিত রায়, আদালতে চারজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন, যেখানে প্রত্যেকের ভূমিকা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
বিচারকার্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ: আদালতের ধারাবাহিকতা
আদালতে শুরু হয় দীর্ঘ সাক্ষ্যগ্রহণ ও প্রমাণ উপস্থাপন। রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে অতিরিক্ত পিপি এসএম আব্দুর রাজ্জাক সাক্ষ্য উপস্থাপন ও যুক্তিতর্ক পরিচালনা করেন। সাক্ষ্য, ফরেনসিক রিপোর্ট, মোবাইল ট্র্যাকিং ডেটা এবং জবানবন্দি সবকিছু বিশ্লেষণ করে বিচারক এক ঐতিহাসিক রায় দেন।
রায় ঘোষণা: তিনজনের মৃত্যুদণ্ড ও একজনের কারাদণ্ড
২০২৫ সালের ৩ আগস্ট, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতের বিচারক জয়ন্তী রাণী দাস, রায়ে ঘোষণা করেন:
- জুয়েল খান, হারুন অর রশীদ ও আলামিন—এই তিনজনের প্রতিজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৪০ হাজার টাকা করে জরিমানা, রাসেল মোল্যা—২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৩ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড
আসামিদের বর্তমান অবস্থা ও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা
রায়ের সময় হারুন অর রশীদ ও রাসেল মোল্যা কারাগারে আটক ছিলেন। তবে জুয়েল খান সম্প্রতি আদালত চত্বরে পুলিশ পাহারায় থাকা অবস্থায় পালিয়ে যান, যা পুলিশের অবহেলার একটি বড় উদাহরণ হয়ে ওঠে। অপরদিকে, আল আমিন জামিনে মুক্তি পেয়ে পলাতক রয়েছে। আদালতের রায় অনুসারে, তাদের গ্রেপ্তারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।