যশোরের খ্যাতিমান সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্ট ও মুক্তিযোদ্ধা রুকুনউদ্দৌলাহ্ ছিলেন সত্যের নির্ভীক কণ্ঠস্বর। তাঁর কলমে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না—ছিল সরলতা, সততা এবং সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। জীবনের নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়েও তিনি সত্য প্রকাশে আপসহীন ছিলেন। মানুষের পথ দেখানো, সমাজকে আলোকিত করা এবং সাংবাদিকতার প্রকৃত আদর্শ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য।
২০২৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর যশোর টাউন হল ময়দানের রওশন আলী মঞ্চে আয়োজিত নাগরিক শোকসভায় তাঁর সহকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক কর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ স্মৃতিচারণ করেন। সভার শুরুতে উদীচী যশোর সংসদের শিল্পীগোষ্ঠী ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গান পরিবেশন করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এক মিনিট নিরবতা পালনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে শোকসভা শুরু হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেত্রী হাবিবা শেফা। উপস্থিত বক্তারা তাঁর কর্মময় জীবন, সামাজিক অবদান এবং সাংবাদিকতার প্রতি অবিচল নিষ্ঠার কথা তুলে ধরেন।
জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাবেরুল হক সাবু বলেন,“রুকুনউদ্দৌলাহ্ যশোরের সাংবাদিকদের অভিভাবক ছিলেন। তাঁর কলম ছিল অদম্য—যে কলমকে কখনো বেঁকানো যায়নি। তিনি সাংবাদিক তৈরি করেছেন, গণমানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন।”
যশোর সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি একরাম-উদ-দ্দৌলা উল্লেখ করেন,“রুকুনউদ্দৌলাহ্ ছিলেন আপাদমস্তক সাংবাদিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক এবং নির্ভীক মানুষ ছিলেন তিনি। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা তাঁর লেখা বই পড়লে নিজেদের জ্ঞানে ও চেতনায় সমৃদ্ধ হতে পারবে।”
শোকসভায় মুক্তিযোদ্ধা অশোক রায় বলেন,“যশোরের সাংস্কৃতিক নক্ষত্র সুকুমার দাসের পাশাপাশি সাংবাদিকতার আকাশে রুকুনউদ্দৌলাহ্ ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ, সৎ ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক। যশোরে সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ছিলেন তিনি।”
প্রেস ক্লাব যশোরের সাধারণ সম্পাদক এস এম তৌহিদুর রহমান স্মৃতিচারণ করে বলেন,“তিনি শুধু সংবাদই সৃষ্টি করেননি, নতুন সাংবাদিকও তৈরি করেছেন। তাঁর লেখনীতে চোরাচালানের ট্রেন থেমে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তিনি সঠিকভাবে তুলে ধরেছেন, ধার করা ইতিহাস নয়। তাঁর আদর্শ আজও সাংবাদিকতার পথপ্রদর্শক।”
রুকুনউদ্দৌলাহ্-র মেয়ে সুম্মিতা দৌলা মিষ্টি নাগরিক শোকসভা আয়োজনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন,
“আমার বাবা আমার আদর্শ, তিনি সবসময় হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।”
বক্তারা দাবি জানান, তাঁর হাতে গড়া মুক্তিযোদ্ধা পাঠাগার এবং পাক্ষিক যশোরের কাগজ চালু রাখতে হবে।
২২ আগস্ট ২০২৫ সালে মৃত্যুবরণ করা রুকুনউদ্দৌলাহ্ ছিলেন একজন কিংবদন্তি সাংবাদিক। হৃদরোগ ও কিডনিজনিত অসুস্থতায় ভুগলেও তিনি শেষ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকতার সেবা দিয়ে গেছেন।
তিনি পাঁচ দশকেরও বেশি সময় সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি দৈনিক সংবাদ, চ্যানেল আই, রেডিও টুডে, দৈনিক স্ফুলিঙ্গ, ঠিকানা, রানার, কল্যাণ-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি যশোরের কাগজ-এর উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
রুকুনউদ্দৌলাহ্ শুধু একজন সাংবাদিক নন, ছিলেন সাংবাদিক তৈরির এক জীবন্ত পাঠশালা। তাঁর নিরপেক্ষতা, সাহসী অবস্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে সাংবাদিকতা শুধু খবর পরিবেশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারও হতে পারে।
সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ্ ছিলেন সততার প্রতীক, সাহসের প্রতিচ্ছবি এবং যশোর তথা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার আলোকবর্তিকা। তাঁর অমর স্মৃতি ও আদর্শ নতুন প্রজন্মকে সত্যের পথে পরিচালিত করবে। সাংবাদিকতার প্রতিটি অধ্যায়ে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।