১৯৮৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। যশোর জেনারেল হাসপাতালের করিডরে আমার জীবনে প্রবেশ করেছিলেন এক অনন্য মানুষ—সাংবাদিক রুকুনউদ্দৌলাহ। সেদিন আমার মায়ের অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হচ্ছিল। আমি তখন শার্শার গ্রামের ছেলে, পাকশিয়া হাই স্কুলের ছাত্র। হাসপাতালে এসে দেখলাম, আমার ভাইয়ের সঙ্গে উপস্থিত হয়েছেন রুকুনউদ্দৌলাহ ভাইও। শুধু তাই নয়, তিনি আমার মাকে এক ব্যাগ রক্তও দিয়েছিলেন। সেদিনের সেই প্রথম দেখা—এক টগবগে, হালকা-পাতলা যুবক, যিনি ধীর স্বরে কথা বলেন, অথচ ভেতরে অসীম দৃঢ়তা ও আন্তরিকতায় ভরপুর।
প্রথম পরিচয়ের পর ধীরে ধীরে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ১৯৮৫ সালে যখন দৈনিক কল্যাণ প্রকাশিত হলো, আমার ভাই সেখানে কাজ করতেন। গ্রাম থেকে শহরে এলেই আমি সেই অফিসে যেতাম আর রুকুন ভাইয়ের সান্নিধ্য পেতাম। পরবর্তীতে, ২০০০ সালে পুরোপুরি সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হয়। সময় যত গড়িয়েছে, তত তিনি আমার কাছে হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা।
রুকুনউদ্দৌলাহ ভাই শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর লেখা দৈনিক সংবাদ-এর নিয়মিত কলাম “গ্রাম গ্রামান্তরে” তখন হাজারো পাঠকের কাছে ছিল এক জনপ্রিয় নাম। আমিও তাঁর লেখা নিয়মিত পড়তাম এবং তাঁর প্রতিটি বই সংগ্রহ করেছি।
তবে শুধু লেখা নয়, তাঁর ব্যক্তিত্ব, মন-মানসিকতা এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে আলাদা করে তুলেছিল। তিনি সবসময় মানুষের মতামতকে মূল্য দিতেন, এমনকি বিপরীত মতাদর্শের লোককেও সন্মান করতেন। এই বিরল গুণ তাঁকে সাধারণ থেকে অসাধারণ করে তুলেছিল।
যশোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় রুকুনউদ্দৌলাহ ভাই ছিলেন এক সাহসী সৈনিক। শতবর্ষী জিলা পরিষদ ভবন কিংবা সাবেক কালেক্টরেট ভবন রক্ষার আন্দোলনে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি কখনও প্রবাহে ভেসে যাননি, বরং দৃঢ় কণ্ঠে দাঁড়িয়েছেন যশোরের ঐতিহ্যের পক্ষে।
তাঁর জন্যই যশোরের সাংস্কৃতিক আন্দোলন শক্ত ভিত্তি পেয়েছিল। স্থানীয় সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে ইতিহাস সংরক্ষণ—প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি রেখে গেছেন এক অমলিন ছাপ।
আমার কাছে তিনি শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, ছিলেন একজন অভিভাবকের মতো মানুষ। যশোরের অজপাড়াগাঁ থেকে শহর—অসংখ্য স্থানে আমরা একসাথে ঘুরেছি, অসংখ্য স্মৃতি গড়ে উঠেছে। তাঁর আন্তরিকতা, স্নেহ আর পরামর্শ আজও আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন মানুষ শুধু কলম দিয়ে নয়, নিজের মন-মানসিকতা, মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক দায়িত্ববোধ দিয়েও সমাজকে বদলে দিতে পারেন।
রুকুনউদ্দৌলাহ ভাইয়ের অকালে চলে যাওয়া আমাদের জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি শুধু সাংবাদিকতার জগতের নন, যশোরের সংস্কৃতি ও ইতিহাসেরও অমূল্য সম্পদ ছিলেন। তাঁর শূন্যতা শুধু সংবাদপত্রের পাতায় নয়, আমাদের হৃদয়ের ভেতরও ব্যথার দাগ কেটে দিয়েছে।
আজ তিনি আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে নেই। তবুও তিনি বেঁচে আছেন তাঁর লেখায়, তাঁর সংগ্রামে আর অসংখ্য মানুষের স্মৃতিতে। রুকুনউদ্দৌলাহ ভাই ছিলেন যশোরের আত্মা ও চেতনার প্রতীক। তাঁর আদর্শ নতুন প্রজন্মকে পথ দেখাবে, প্রেরণা যোগাবে।
রুকুনউদ্দৌলাহ ভাইয়ের জীবন আমাদের শেখায়—অন্তরের দৃঢ়তা, সততা আর সাংস্কৃতিক দায়িত্ববোধ দিয়ে একজন মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। তিনি ছিলেন যশোরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর নাম, তাঁর কাজ এবং তাঁর স্মৃতি চিরকাল বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে।
✍️ জীবনী ও তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ২৩ আগস্ট ২০২৫