বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষি ও মৎস্য খাতের ওপর নির্ভরশীল। এ খাতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যশোরের কেশবপুর ও আশপাশ এলাকায় কৃষকের অজান্তেই “প্রাকৃতিক ফিল্টার” নামে পরিচিত শামুক নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। এতে যেমন কৃষক ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায় সরাসরি প্রভাবিত হচ্ছে, তেমনি প্রাকৃতিক ভারসাম্যও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।
যশোরের কেশবপুর ও আশপাশ এলাকায় কৃষকের অজান্তেই প্রাকৃতিক পানি শোধন ফিল্টার হিসেবে পরিচিত শামুক নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। এ কারণে মৎস্য ও কৃষি বিভাগ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি এখনই শামুক নিধনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হয় তবে পুরো অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মৎস্য ও কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, শামুকের শরীরে রয়েছে প্রাকৃতিক পানি শোধন ব্যবস্থা। এরা দূষিত পানি পান করে ভেতরে ময়লা ধরে রাখে এবং বাইরে বিশুদ্ধ পানি ছেড়ে দেয়। পাশাপাশি শামুকের দেহ থেকে জমিতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশ জমা হয়, যা ফসল উৎপাদন ও মাছ চাষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, যেখানে বেশি শামুক থাকে, সেসব জমি আরও উর্বর হয় এবং ফলন ভালো হয়। তাই শামুক নিঃশব্দে কৃষকের বন্ধুর মতো কাজ করে।
ভবদহ অঞ্চলের কেশবপুর উপজেলায় রয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার বিঘা জমিতে ঘের ও ৬ হাজারের বেশি পুকুর। মনিরামপুর উপজেলায় প্রায় ৬৯ হাজার বিঘা জমিতে ঘের এবং ৩৪ হাজার বিঘায় ১১ হাজারেরও বেশি পুকুর রয়েছে। অন্যদিকে অভয়নগর উপজেলায়ও হাজার হাজার বিঘা জমিতে ঘের ও পুকুর আছে। এর বাইরে তিন উপজেলায় অসংখ্য জলাবদ্ধ বিল রয়েছে, যেখানে স্থানীয় দরিদ্র নারী, পুরুষ ও শিশুরা শামুক ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে।
এ শামুক তারা ৭–৮ টাকা কেজি দরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে। সকালে বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে পাইকাররা ভ্যান ও সাইকেল নিয়ে দাঁড়ায়, আর গ্রামবাসীরা সেখানে শামুক বিক্রি করে আসে।
পাইকাররা শামুক থেকে মাংস আলাদা করে ৫০–৬০ টাকা কেজি দরে মাছের ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি করে। আর শামুকের খোল প্রতি বস্তা ১২০–১৫০ টাকায় বিক্রি হয় চুন কারখানায়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিটি কেজি শামুক কিনে তারা ২০–৩৫ টাকা পর্যন্ত লাভ করে।
মনিরামপুরের গোপালপুর ও চেচুড়িয়ায় তিনটি বড় চুন কারখানা রয়েছে, যেখানে পাহাড়সম শামুকের খোল মজুত করা হয়েছে। এসব কারখানা থেকে উৎপাদিত চুনের বড় অংশ মাছের ঘের মালিকরা কিনে থাকেন। কারখানার মালিকরা পাইকারদের অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখেন যাতে তারা নিয়মিত শামুক সংগ্রহ করতে পারে।
কেশবপুরের আড়–য়া গ্রামের ফতেমা বেগম বলেন, তাঁর পরিবারের কয়েকজন প্রতিদিন বিল ও পুকুর থেকে এক থেকে দেড় মন শামুক ধরে বিক্রি করেন। এতে তাঁদের সংসার চলে।
সাগরদত্তকাটি গ্রামের শামুক ব্যবসায়ী জয়দেব জানান, তিনি বিল থেকে শামুক কিনে কপালিয়ার মাছের ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি করেন এবং এতে ভালো লাভ হয়।
চুন কারখানার মালিক সমিরন দাস জানান, তাঁর কারখানায় উৎপাদিত চুনের তিন ভাগের দুই ভাগ ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি হয় এবং বাকিটা পান ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়।
সচেতন মহল মনে করছে, শামুক নির্বিচারে নিধন হলে পানির মান নষ্ট হয়ে যাবে, রোগ জীবাণুর বিস্তার ঘটবে এবং প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।
মৎস্য কর্মকর্তা সুদীপ বিশ্বাস বলেন, শামুক পানি বিশুদ্ধ রাখে এবং এর ওপর নির্ভরশীল মাছ যেমন কই, শোল, শিং ও কার্প প্রজাতির মাছ টিকে থাকে। শামুক কমে গেলে পানির রং বদলাবে এবং মাছ মারা যাবে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার মুহাম্মদ রফিকুল আলম বলেন, শামুক প্রকৃতির খাদ্য শৃঙ্খলার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। নির্বিচারে শামুক ধরা হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে।
২০১২ সালের ১০ জুলাই জারি করা সরকারি প্রজ্ঞাপনে শামুককে বন্যপ্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে শামুক ধরা ও বিক্রি আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে আইন প্রয়োগ না থাকায় শামুক নিধন অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বিদ্যমান মৎস্য আইনে শামুক রক্ষার বিশেষ কোনো ধারা নেই।
যশোর অঞ্চলে শামুক নিধন অর্থনৈতিকভাবে কিছু পরিবারকে স্বল্পমেয়াদে লাভবান করলেও দীর্ঘমেয়াদে কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই এখনই সরকারি নজরদারি, কঠোর আইন প্রয়োগ ও বিকল্প জীবিকা কর্মসূচি চালু করা জরুরি। অন্যথায় শামুক নিধনের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়বে এবং কৃষকের প্রকৃত বন্ধু এই ছোট্ট প্রাণি বিলুপ্তির পথে যাবে।