বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরল ৫ আগস্ট ২০২৫, যখন জাতি প্রত্যক্ষ করল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেন, ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে। একইসাথে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’টি পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সাংবিধানিক সংস্কারে সংবিধানের তফসিলে সন্নিবেশিত করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ: একটি নতুন দিগন্তের সূচনা
জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজার অনুষ্ঠানে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন,
“৫ আগস্ট ২০২৪ সালে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল, সেটি ছিল জনগণের বিজয়। সেই ছাত্র-জনতার দাবি আজ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করবে।”
ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবেই এই ঘোষণা প্রণীত হয়েছে।
শহীদদের স্বীকৃতি: জাতীয় বীরের মর্যাদা
ঘোষণাপত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
“জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করা হলো।”
এছাড়াও শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইনি সুরক্ষা ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক মাইলফলক, যেখানে রাষ্ট্র নিজেই আন্দোলনের আত্মত্যাগ ও আকাঙ্ক্ষাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিল।
সাংবিধানিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি
জুলাই ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয় যে,
“আগামী একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন শেষে গঠিত জাতীয় সংসদ একটি সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে আইনের শাসন, মানবাধিকার, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবে।”
এই সংস্কারে যে বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে সেগুলো হলো:
- দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠন
- বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন রাষ্ট্র গঠন
- তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা পূরণে কার্যকর ব্যবস্থা
- মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
- সংবিধানের তফসিলে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ অন্তর্ভুক্ত করা
রাজনৈতিক ঐক্যের নিদর্শন: একমঞ্চে বিভিন্ন দলের শীর্ষনেতারা
উক্ত অনুষ্ঠানে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের উপস্থিতি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তারা সবাই জুলাই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে এক নতুন জাতীয় ঐকমত্যের বার্তা প্রদান করেন।
এই সংহতি প্রমাণ করে যে, গণতান্ত্রিক ও জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টায় সকল রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ।
তরুণদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের রূপরেখা
ঘোষণাপত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা ও তাদের ভবিষ্যৎকে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে:
“দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের চিন্তা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা সংস্কার করা হবে।”
এটি স্পষ্ট যে, এই ঘোষণাপত্র শুধুমাত্র একটি প্রস্তাব নয়; বরং এটি একটি ভবিষ্যৎ নীতিমালার ভিত্তিপ্রস্তর।
একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের পথে প্রথম পদক্ষেপ
জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রবেশ করলো একটি নতুন যুগে। ইতিহাসের পাতায় লেখা হলো এক সাহসী অধ্যায়, যেখানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ, দাবিদাওয়া ও চেতনা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেল।
এই ঘোষণাপত্র কেবল অতীতের সম্মাননা নয়, বরং এটি ভবিষ্যতের একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অঙ্গীকার।