বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বের উত্তরাধিকার সবসময়েই এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চার দশকের বেশি সময় ধরে দলের হাল ধরে রেখেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বয়স, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং প্রবাসজীবনের কারণে তিনি দলের নেতৃত্বে উত্তরসূরি নির্ধারণের বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা
১৯৮১ সালের ১৭ই মে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। তারপর থেকে একটানা ৪৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি দলের শীর্ষ নেতৃত্বে আছেন। এই দীর্ঘ সময়ে দলের ভেতরে উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে তিনি কখনো প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে দিকনির্দেশনার অভাব দলকে বিপর্যস্ত করে তোলে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যায়।
ভারতে অবস্থান ও নেতৃত্ব হস্তান্তরের চাপ
শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে দিল্লিতে অবস্থান করছেন। তার রাজনৈতিক কার্যক্রমে নানা বিধিনিষেধ থাকলেও এখানেই তিনি উত্তরাধিকার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার দিকে মন দিচ্ছেন। চলতি মাসেই তিনি ৭৮ বছরে পা দিচ্ছেন—যা নেতৃত্ব হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তাকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
নতুন নেতৃত্বে ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’
বিবিসি বাংলা সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দলের নেতৃত্বে আনতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এছাড়া শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন।
ভারতের কংগ্রেসের রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেল অনুসরণ করেই আওয়ামী লীগেও পারিবারিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছেন শেখ হাসিনা।
সজীব ওয়াজেদ জয়: আন্তর্জাতিক মুখপাত্র
সজীব ওয়াজেদ বর্তমানে মার্কিন নাগরিক হলেও আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র হিসেবে সক্রিয়। তিনি নিয়মিত গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন এবং দলের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবস্থান তুলে ধরছেন। বিদেশি কূটনীতিক ও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
সায়মা ওয়াজেদ পুতুল: প্রত্যক্ষ সহযোগী
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়েছে সায়মা ওয়াজেদকে। এর ফলে তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোযোগী হয়েছেন। দিল্লিতেই মায়ের পাশে থেকে তিনি ভাষণের খসড়া তৈরি, কর্মসূচি পরিকল্পনা ও বৈঠকের আয়োজন করছেন।
বাইরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। ফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কাঠামোয় তার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
আওয়ামী লীগের ভেতরে প্রতিক্রিয়া
দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকে জানেন এই উত্তরাধিকার পরিকল্পনার কথা। তবে বিষয়টি এতটাই স্পর্শকাতর যে কেউ প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চান না। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করেছেন, দলের ভেতরে এ নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি।
তবে তিনি স্বীকার করেছেন, নেত্রীর পরিবারের সদস্যরা যেমন, তেমনি দলের নেতা-কর্মীরাও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করছেন।
ওবায়দুল কাদেরের গুরুত্ব হ্রাস
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কার্যত উপেক্ষিত হয়ে পড়েছেন। প্রায় দশ মাস ধরে তিনি ভারতে থেকেও শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। বরং তিন নেতা—আসাদুজ্জামান খান কামাল, বাহাউদ্দিন নাসিম ও জাহাঙ্গীর কবির নানক—দলের কলকাতা কেন্দ্রিক নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পাচ্ছেন।
কংগ্রেসের রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেল
ভারতের কংগ্রেস পার্টিতে সোনিয়া গান্ধীর পরিবর্তে ধীরে ধীরে নেতৃত্ব নিয়েছেন রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। বড় ভাই রাহুল সামনের সারিতে, আর প্রিয়াঙ্কা তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। শেখ হাসিনা সেই মডেলই অনুসরণ করতে চাইছেন।
গান্ধী পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক
গান্ধী পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। সোনিয়া গান্ধী ও তিনি প্রায় সমবয়সী এবং একে অপরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। ২০২৩ সালে দিল্লি সফরে তিনি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে বিশেষভাবে সাক্ষাৎ করেন এবং তার রাজনৈতিক যাত্রা নিয়ে বিস্তারিত জানতে চান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত
ভারতের প্রবীণ বিশ্লেষক বিনোদ শর্মা মনে করেন, আওয়ামী লীগের জন্য পরিবারকেন্দ্রিক উত্তরাধিকার স্বাভাবিক বিষয়। কংগ্রেস যেমন গান্ধী পরিবারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, তেমনি আওয়ামী লীগও শেখ হাসিনার পরিবারকে ঘিরেই টিকে থাকবে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।