যশোরের ইছালী গ্রাম আমাদের কাছে এক অনন্য অভিজ্ঞতার নাম। মনোহরপুর বাজার থেকে পুব দিকে একটু এগোলেই এই শান্ত, গোছানো গ্রামটি চোখে পড়ে। ক’দিন আগে এক কাজে আমরা গিয়েছিলাম এই গ্রামে। ছোট্ট অথচ বিস্তৃত সবুজে ঘেরা এই এলাকা আমাদের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
ইছালী গ্রামের অবস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থা
ইছালী গ্রাম যশোর-মাগুরা সড়ক সংলগ্ন হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। একসময় যেখানে কাঁচা পথ ছিল, এখন সেসব জায়গায় পাকা রাস্তা তৈরি হয়েছে। স্থানীয় মানুষের চলাফেরা, কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ সবই সহজ হয়ে গেছে। এই উন্নয়ন গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
গ্রামের প্রকৃতির রূপ ও ঋতুর পরিবর্তন
আমরা যখন বিকেলের দিকে গ্রামে ঢুকলাম, চারপাশে এক অদ্ভুত শান্তি। নীল আকাশে সাদা মেঘ, যেন শরতের আগমনবার্তা দিচ্ছে। তবুও এখনো শরৎ পুরোপুরি আসেনি। গ্রামের ভেতরের দৃশ্যপট মন ছুঁয়ে যায়। বৃষ্টির পর গাছের পাতাগুলো একদম ধুয়ে-মুছে টাটকা সবুজ হয়ে ওঠে। সেই সবুজ পাতা চোখ জুড়িয়ে দেয়।
কৃষকের জীবন ও মাঠের গল্প
এই গ্রামের প্রাণ কৃষি। বিকেলে আমরা দেখলাম—একজন কৃষক দিনভর কাজ সেরে মই দিয়ে মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছেন। তার মুখে পরিশ্রমের ছাপ, তবু তৃপ্তির হাসি স্পষ্ট। গ্রামের মানুষের এই অক্লান্ত শ্রমই তো আমাদের খাদ্যের যোগান দেয়। ধান, পাট, শাকসবজি—সবই এখানকার জমি থেকে আসে।
বদলে যাওয়া ইছালী: আধুনিকতার ছোঁয়া
একসময় ইছালীতে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট এসব ছিল না বললেই চলে। এখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে গেছে। অনেকেই স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে, নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করছে। এই প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রাম বদলাচ্ছে, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: গ্রামবাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ
ইছালী গ্রামের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। বিশাল মাঠ, সবুজ ধানক্ষেত, দূরে দিগন্ত জোড়া বটগাছ—সব মিলিয়ে এক টুকরো শ্যামল বাংলার ছবি। গ্রামের ভেতর দিয়ে ছোট খাল বয়ে গেছে, যেখানে শীতকালে অতিথি পাখিরা আসে। বর্ষার দিনে নদী, খাল-সবই পূর্ণ জলে টইটম্বুর।
মানুষের আতিথেয়তা ও সহজ সরল জীবন
গ্রামের মানুষ সহজ-সরল। কেউ নতুন এলেই আপন করে নেন। পথচলতি মানুষকে দাওয়াত দিয়ে চা-নাশতা খাওয়ানো যেন এখানকার রীতি। আমরা যেখানে দাঁড়াই, সেখানেই হাসিমুখে গল্প। মানুষের আন্তরিকতা এখনো গ্রামবাংলার বড় সম্পদ।
ইছালীতে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চা
গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা—সবই আছে। নতুন প্রজন্ম পড়াশোনা করছে, স্বপ্ন দেখছে বড় কিছু হওয়ার। গ্রামের কিছু তরুণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। নাচ, গান, নাটক—সবই মিলে এক অন্যরকম প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি করে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা, হরেক উৎসব এখানকার মানুষের আনন্দের উপলক্ষ।
চলমান সমস্যার চিত্র
সবকিছুই কি ভালো? না। এখনো কিছু সমস্যা আছে। বর্ষাকালে নিচু এলাকা জলাবদ্ধ হয়। বেকারত্বও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষিত তরুণরা শহরমুখী হচ্ছে, ফলে গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়ানো প্রয়োজন। তবু সবকিছুর মাঝেও গ্রামের মানুষ আশাবাদী।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন
আমরা বিশ্বাস করি, একদিন এই ইছালী গ্রাম হবে আরও সুন্দর, আরও সমৃদ্ধ। প্রযুক্তি আর প্রকৃতির মেলবন্ধনেই গড়ে উঠবে নতুন বাংলাদেশ। গ্রামের ছোট ছোট রাস্তা, খাল-বিল, সবুজ মাঠ—সবই টিকে থাকবে আধুনিকতার সাথে।
শেষ কথায়
ইছালী গ্রামের গল্প কোনো একক গ্রামের নয়, পুরো বাংলার গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। এখানে এসে প্রকৃতি আর মানুষের মেলবন্ধন দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। এই গ্রাম আমাদের শেখায়—প্রকৃতিকে ভালোবাসলে প্রকৃতি আপনাকে ভালোবাসবেই।