অভয়নগর উপজেলার পুড়াখালী বাওড় আজ শুধু একটি জলাশয় নয়, বরং এটি পরিণত হয়েছে প্রকৃতি, মাছ ও অতিথি পাখির এক অপূর্ব মিলনমেলায়। কালো পানির ঝিলিক, চারপাশের সবুজ বনানী আর নীল আকাশের সীমাহীন বিস্তার—সব মিলিয়ে পুড়াখালী বাওড় যেন এক জীবন্ত কবিতার নাম।
একসময় এ বাওড় ছিল প্রায় পরিত্যক্ত। ২০০০ সালের পূর্বে কচুরিপানা ও ঝোপঝাড়ে ভরে গিয়ে এর অস্তিত্বই হারানোর উপক্রম হয়েছিল। স্থানীয় মানুষ তখন এ জলাশয় থেকে কোনো উপকার পাচ্ছিল না। কিন্তু ২০০০ সালের ২০ জুলাই “ইফাদ প্রকল্পের” অধীনে শুরু হয় এর নতুন যাত্রা। আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্যচাষের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং ১০৮ জন মৎস্যচাষীর হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। এর পর থেকেই বদলে যেতে থাকে বাওড়ের ভাগ্য।
বর্তমানে পুড়াখালী বাওড় একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মডেল। এখানে তৈরি হয়েছে ভেড়িবাঁধ, অভয়াশ্রম, ফিস ল্যান্ডিং সেন্টার ও পাঁটা বাঁধ। ফলে জলাশয়টি মাছচাষের জন্য হয়ে উঠেছে আরও উপযোগী। মাছচাষীরা এখন নিয়মিত উৎপাদন বাড়িয়ে নিজেদের জীবন-জীবিকা সমৃদ্ধ করছেন। একসময় যে বাওড় ছিল অব্যবহৃত, আজ তা হয়ে উঠেছে স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম ভরসাস্থল।
শীতের শুরুতেই পুড়াখালী বাওড় হয়ে ওঠে অতিথি পাখিদের স্বর্গরাজ্য। দূর সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার পাখি এখানে আসে আশ্রয়ের খোঁজে। তাদের ঝাঁক আকাশে ওড়ে কিংবা একসাথে জলে নামে—দৃশ্যটা যেন স্বপ্নের মতো লাগে। দিনের শুরু থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাখিদের কোলাহলে ভরে ওঠে চারপাশ।
প্রশাসনের কঠোর নজরদারিতে শিকার বন্ধ হওয়ায় এখন অতিথি পাখিরা নিরাপদে বাস করতে পারে। শীত মৌসুমে হাঁস, পাতিহাঁস, কাদাখোঁচা, বক, পানকৌড়ি, ডাহুকসহ নানা প্রজাতির পাখি এখানে নিয়মিত আসে। এছাড়া বাওড়ের তীর ঘিরে শালিক, দোয়েল, ঘুঘু, মাছরাঙা, গাংচিলের মতো স্থানীয় পাখিদের উপস্থিতিও প্রাণবন্ত করে তোলে পরিবেশকে।
পুড়াখালী বাওড় কেবল মাছচাষ বা পাখিদের আশ্রয় নয়, মানুষের মনকেও দেয় এক অন্যরকম প্রশান্তি। ভোরের নরম আলো বা বিকেলের শেষ রোদে যখন কেউ বাওড়ের তীরে দাঁড়ায়, তখন প্রকৃতির বিশাল নীলিমা, শান্ত জলের ঢেউ আর পাখিদের সুরেলা ডাক মানুষকে মুহূর্তেই মুগ্ধ করে।
এ জায়গাটি যেন মানুষের জন্যও মানসিক প্রশান্তির এক আশ্রয়। ব্যস্ত জীবনের ভিড়ে একটু শান্তি খুঁজতে পুড়াখালী বাওড় হয়ে উঠেছে স্থানীয় ও দূরদূরান্তের মানুষের প্রিয় স্থান।
আজকের দিনে পুড়াখালী বাওড় একটি সফল মডেল, যেখানে মানুষ, মাছ ও পাখির সহাবস্থান তৈরি হয়েছে। জলে, স্থলে আর আকাশে চলমান প্রাণের এই কোলাহল প্রকৃতিকে দিয়েছে এক অনন্য মাত্রা।
সব মিলিয়ে বলা যায়, পুড়াখালী বাওড় শুধু একটি জলাশয় নয়, বরং এটি প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও মানুষের আবেগের মেলবন্ধন। যার সৌন্দর্য আর সজীবতা যে কোনো দর্শনার্থীর হৃদয়কে অনায়াসেই মুগ্ধ করবে।
✍️ তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ২৮ আগস্ট ২০২৫