শ্রাবণের বর্ষায় হারানো স্মৃতির চারণভূমি
শ্রাবণ মাসের আগমন মানেই আমাদের বাংলার মাঠে, নদী-নালায় নতুন প্রাণের সঞ্চার। প্রকৃতি তার আপন ছন্দে ফিরে আসে; মেঘে ঢাকা আকাশ, সিক্ত ধুলোর গন্ধ, বাতাসে ধানের গন্ধ—সবকিছু মিলিয়ে যেন ফেলে আসা জীবনের দরজায় টোকা দেয়।
আমাদের ছেলেবেলার সেই শ্রাবণ আর আজকের শহুরে শ্রাবণ—দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। তখন প্রযুক্তি ছিল না, ছিল নিখাদ সময়ের স্বাদ নেওয়ার মানসিকতা। সেই সময় শ্রাবণ মানে ছিল মাঠে নামা, ধানক্ষেতের পানিতে মাছ ধরা, আর বিকেলে লুঙ্গির খুঁটে কুড়ানো মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরা।
ধানক্ষেতে মাছ ধরার সরল অথচ রোমাঞ্চকর খেলা
শ্রাবণের রোদে যখন আকাশে মেঘের সঙ্গেও থাকে কড়া রোদ, তখন মাঠের জমে থাকা পানির নিচে থাকা মাছ গুলো অনেক সময়ই ওপরের দিকে ভেসে উঠে। সেই সময় কোনো জাল কিংবা মাছ ধরার ফাঁদ নয়—শুধু চোখের তীক্ষ্ণতা, ধৈর্য আর খেলায় মেতে থাকা হাতে আমরা মাছ তুলতাম। এটা ছিল একধরনের প্রতিযোগিতা—কে বেশি তুলতে পারে, কে বেশি সুন্দর মাছ ধরেছে।
আমরা বন্ধুরা তখন হাঁটু পর্যন্ত কাদায় নেমে পড়তাম। কেউ বাঁশের ডগা দিয়ে হালকা করে পানির নিচে খোঁচা মারত, কেউ আবার হাত দিয়ে ধীরে ধীরে মাছের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করত। শিঙে, টাকি, মাগুর, কৈ—এরা ছিল আমাদের মূল শিকার।
গাঁয়ের মাঠে সেই সরল আনন্দের ছোঁয়া
আজকের দিনে হয়তো মনে হয়, এটা কোনো বড় ঘটনা না। কিন্তু আমরা যারা সেই সময়ের ভেতর দিয়ে গেছি, তারা জানি একটা মাছ ধরার দিন মানেই ছিল একটা উৎসবের মতো অনুভব। তখন ইন্টারনেট ছিল না, স্মার্টফোন ছিল না, কিন্তু ছিল সময়কে উপভোগ করার অসাধারণ ক্ষমতা।
কেউ কেউ মাছগুলো লুঙ্গির খুঁটে জড়াত, কেউবা বাঁশের তৈরি ছোট বালতিতে রেখে দিত। পছন্দের মাছ পেলে গর্বে চোখ চকচক করত। মা বা দিদিমা যখন বলত, “আজ নিজে হাতে মাছ ধরেছিস? আচ্ছা, রান্না করেই খাওয়াব,” তখন আনন্দটা আরও দ্বিগুণ হয়ে যেত।
বর্ষায় বদলে যাওয়া প্রকৃতির রূপ
শ্রাবণের বর্ষা শুধু স্মৃতি নয়, এটি একটি ঋতুচক্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। ধানক্ষেতে পানি জমা, মাঠে পাখিদের কলকাকলি, সাপ-ব্যাঙের ডাক—সব মিলিয়ে বাংলার প্রকৃতি এক অপূর্ব রঙে রাঙিয়ে দেয় নিজেকে।
শ্রাবণের দুপুরবেলা যখন মাথার ওপরে সূর্য আগুন ঢালে, তখনই সবচেয়ে বেশি মাছ দেখা যেত পানির উপর। কারণ, জমে থাকা উষ্ণ পানিতে মাছগুলো ক্লান্ত হয়ে ভেসে উঠত। আমরা সেই সময়টাকেই বেছে নিতাম মাছ ধরার জন্য। একটু তীক্ষ্ণ নজর আর নিঃশব্দে হাঁটার অভ্যাস থাকলে, মাছ ধরতে অসুবিধে হতো না।
মাছ ধরার স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকা গ্রামীণ সংস্কৃতি
আজ আমরা যতই শহরের দিকে এগিয়ে যাই না কেন, এই স্মৃতিগুলো আমাদের অন্তরে গেঁথে থাকে। গাঁয়ের মাঠে মাছ ধরা ছিল শুধু খেলা নয়, এটি ছিল একধরনের সামাজিক সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্র। বন্ধুত্ব গড়ে উঠত এইসব ছোট ছোট আনন্দে।
শুধু বন্ধুত্ব নয়, এই মাছ ধরার সময়টায় একে অপরের পাশে দাঁড়ানো, সহযোগিতা করা, আনন্দ ভাগ করে নেওয়া—এসবই ছিল গ্রামীণ জীবনের অদৃশ্য পাঠশালা। আর সেই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনের বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাহায্য করেছে।
প্রযুক্তির যুগে হারিয়ে যাওয়া এক সংস্কৃতি
আমাদের গ্রামগুলো এখন দিন দিন বদলে যাচ্ছে। ধানক্ষেত কমে গেছে, মাঠে পানি জমে না আগের মতো। বর্ষা এলেও শহুরে ছাপ তার ওপর পড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখন বাচ্চারা মোবাইলে গেম খেলে, মাঠে নামে না, ধানক্ষেতে নামে না। কাদায় ডুবে মাছ ধরার যে আনন্দ, তা শুধু স্মৃতির পাতায় লেগে থাকে।
এখন বড় বড় হ্যাচারি, ফিশারি এসেছে। খাল-বিল ভরাট হয়ে গিয়েছে। মানুষ সময় বাঁচাতে চায়, প্রকৃতির কোলে বসে সময় উপভোগ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। অথচ সেই সরল জীবনে সময় যেন নিজে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করত।
মনের কোণে রয়ে যাওয়া জল-রোদ-কাদার গন্ধ
আজও শ্রাবণের কোনো বৃষ্টিভেজা দুপুরে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকলে মনে পড়ে যায় সেই কাদা মাখা পা, গরম রোদের নিচে কুড়োনো শিঙে মাছ, আর বন্ধুদের হুড়োহুড়ি। সেই দিন আর ফিরবে না—তবু স্মৃতির গায়ে এখনো লেগে থাকে জলের গন্ধ, রোদের ঝলক আর খুশির কোলাহল।
শেষ কথা: ফিরে দেখা এক অতীতের শ্রাবণ
প্রতিটি মানুষ কিছু না কিছু স্মৃতি বয়ে চলে। আমাদের সেই শ্রাবণ মানেই মাঠ, পানি, কাদা আর মাছ ধরার সরল আনন্দ। এটা শুধু এক ব্যক্তিগত স্মৃতি নয়, এটি একটি প্রজন্মের অনুভব, একটি দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
তাই যখনই শ্রাবণের বৃষ্টি নামে, মনের পর্দায় আবারও ভেসে ওঠে সেই সরল দিনগুলি। প্রযুক্তির স্পর্শে জীবনের ছন্দ বদলালেও হৃদয়ের ভিতরে আজও গাঁয়ের মাঠে মাছ ধরার দিন বেঁচে আছে চিরসবুজ হয়ে।