বাংলা ভাষা শুধু একটি ভাষা নয়— এটি আমাদের পরিচয়, আমাদের আত্মমর্যাদার প্রতীক। মাতৃভাষা বাংলা আজ বারবার আক্রান্ত হচ্ছে, নানা প্রেক্ষাপটে নানাভাবে। আর ঠিক এই মুহূর্তেই, বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তমকুমারের প্রয়াণ দিবসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা— ‘‘প্রয়োজনে আবার ভাষা আন্দোলন হবে!’’—এ যেন বাংলার মননে নতুন প্রেরণা জাগায়।
মহানায়কের মৃত্যুবার্ষিকী এবং বাংলা ভাষার গৌরবময় সম্মাননা
২৪ জুলাই, মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে আয়োজন করা হয়েছিল রাজ্য সরকারের ‘মহানায়ক সম্মান’ প্রদান অনুষ্ঠান। উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব, বিদেশি কূটনীতিক, উত্তমকুমারের পরিবার ও সহশিল্পীরা।
এই মঞ্চ থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে এল বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা এবং প্রতিবাদ। তিনি ভাষা-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হন, এবং বলেন—“ভাষা সভ্যতা ও সংস্কৃতির মেরুদণ্ড। বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ হলে, আমাদের লড়াই আবার শুরু হবে।”
বাংলা ভাষার ওপর চলমান আক্রমণ ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিবাদ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাংলা ভাষায় কথা বললেই আজ বন্দি হতে হচ্ছে, দেশান্তরী হতে হচ্ছে।’’ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলায় কথা বলার কারণে পরিযায়ী শ্রমিকদের হয়রানি ও বাংলাদেশি তকমা দিয়ে দেশছাড়া করার ঘটনায় তিনি কঠোর প্রতিবাদ জানান।
মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলেন,
“বাংলা ভাষাকে অপমান করবেন না। অন্য ভাষাকে অসম্মান করবো না, তবে বাংলাকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের ভাষা বানানোর চেষ্টাকে বরদাস্ত করা হবে না।”
বাংলা ভাষার গৌরবময় ঐতিহ্য ও আন্তর্জাতিক স্থান
বাংলা ভাষা বিশ্বের পঞ্চম এবং এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা। প্রায় ৩০ কোটির বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষাতেই জন্ম নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যাঁদের রচনায় ভারতীয় সাহিত্য বিশ্বমঞ্চে স্থান পেয়েছে।
বাংলা ভাষার এই গর্বোজ্জ্বল পরিচয় থাকা সত্ত্বেও আজ বাংলাভাষীদের বারবার অপমানিত হতে হচ্ছে—এই বাস্তবতাই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ফুটে ওঠে।
উত্তমকুমার স্মরণে মহানায়ক সম্মান ও শিল্পীদের স্বীকৃতি
২০২৫ সালের ‘মহানায়ক সম্মান’ পেয়েছেন—
- সঙ্গীতশিল্পী রূপঙ্কর বাগচী
- গায়িকা ইমন চক্রবর্তী
- অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী
- জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মেকআপশিল্পী সোমনাথ কুন্ডু
- শিল্প নির্দেশক আনন্দ আঢ্য
- সম্মানজনক ‘শ্রেষ্ঠ মহানায়ক’ হয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ
২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া এই পুরস্কারপ্রদান অনুষ্ঠান এখনও পর্যন্ত ২৫ জনকে মহানায়ক সম্মান দিয়েছে, ৪১ জনকে বর্ষসেরা, এবং ১৪৭ জনকে বিশেষ চলচ্চিত্র পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে।
শিল্পীদের জন্য রাজ্য সরকারের উদ্যোগ
রাজ্য সরকার সিনেমা ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের কল্যাণে বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে—
- ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমা ৪,৮০০ জন শিল্পী ও তাঁদের পরিবারকে
- ফিল্ম ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে দুঃস্থ শিল্পী-কলাকুশলীদের সাহায্য
- নতুন সঙ্গীত অ্যাকাডেমি, যা শীঘ্রই উদ্বোধন হতে চলেছে
এসব উদ্যোগ বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আরও সুদৃঢ় করে তুলেছে।
২১ জুলাইয়ের শহিদ মঞ্চ থেকে নানুর দিবস পর্যন্ত—প্রতিরোধের ডাক
২১ জুলাই শহিদ দিবসে মমতা বলেন—
“বাংলা ভাষার গৌরব ধরে রাখতে দিল্লিতেও লড়াই হবে। বাংলাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না।”
২৭ জুলাই নানুর দিবস থেকে প্রতি শনিবার ও রবিবার রাস্তায় নামার ডাক দিয়েছেন তিনি, বাংলা ভাষার উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে।
বাংলা ভাষা বাঁচানোর এই মুহূর্তে আমাদের করণীয়
আমরা যদি বাংলা ভাষাকে সত্যিই ভালবাসি, তাহলে এখনই আমাদের—
- বাংলা ভাষায় প্রতিদিন কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে
- সন্তানদের মাতৃভাষায় শিক্ষিত করতে হবে
- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাহিত্যচর্চা ও বাংলা গণমাধ্যমকে সমর্থন জানাতে হবে
- বাংলা ভাষার অপমান বা সংকোচে প্রতিবাদী হতে হবে
উপসংহার: বাংলা ভাষার লড়াই শুধুই ভাষার নয়, এটি অস্তিত্বের
‘আবার ভাষা আন্দোলন হবে’—এই ঘোষণার মধ্যে শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, রয়েছে এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বাঙালি জাতির সামনে আবারও এক নতুন চ্যালেঞ্জ। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য লড়াই আজও চলতে হবে।
বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে, ভাষা-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে, আমরা এই আন্দোলনের অংশ হতে পারি।