‘মিনি বাংলাদেশ’ আজ নীরব—পর্যটকশূন্য শহরের হাহাকার
বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কলকাতার অর্থনীতি ভয়াবহ ধাক্কা খেয়েছে। বিশেষত নিউ মার্কেট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, মারকুইস স্ট্রিট এবং সংলগ্ন এলাকাগুলো, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে ‘মিনি বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত ছিল, এখন পর্যটকশূন্য। এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের দাবি, কেবল এখানেই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়েছে, আর পুরো কলকাতা শহর মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার কোটি রুপি।
কূটনৈতিক সংকটের ছায়া পর্যটনে
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান ও সরকারের পতনের প্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলেই নয়াদিল্লি বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ করে দেয়। যদিও কিছু জরুরি ভিত্তির ভিসা এখনো দেওয়া হয়, কিন্তু তা অপ্রতুল এবং পর্যটনভিত্তিক ভ্রমণকারীদের চাহিদা পূরণে অসমর্থ।
করোনার পর ঘুরে দাঁড়ানোয় বাধা
কোভিড-১৯ মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এই নতুন ভিসা-সংকট আবারও কলকাতার পর্যটন খাতকে ধসিয়ে দিয়েছে। এক সময় যেখানে রাস্তাঘাট, হোটেল ও বিপণিবিতানগুলো বাংলাদেশি পর্যটকে মুখর ছিল, এখন সেই জায়গাগুলো কার্যত জনশূন্য। কম খরচে থাকা, সুস্বাদু খাবার এবং উন্নত চিকিৎসাসেবা পাওয়ার আশায় বাংলাদেশিরা কলকাতাকে জনপ্রিয় গন্তব্য হিসেবে বেছে নিতেন। কিন্তু বর্তমানে এসব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পর্যটকের অভাবে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পথে।
ক্ষতির হিসাব: প্রতিদিন ৩ কোটি রুপির লেনদেন বন্ধ
ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী খান জানান, “পর্যটন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্র্যাভেল এজেন্সি, মানি এক্সচেঞ্জ, চিকিৎসা ও পরিবহন—সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি রুপির লেনদেন হতো এই এলাকায়।” এখন অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, আর যারা টিকে আছে, তারাও মারাত্মক ক্ষতির মুখে।
পর্যটন পরিবহন ও ট্র্যাভেল এজেন্সি শিল্পে ধস
এক সময় দিনে একাধিক বাসভর্তি বাংলাদেশি পর্যটক আসত শহরে। কিন্তু এখন টানা কয়েকদিন একটি পর্যটকও দেখা যায় না বলে জানালেন স্থানীয় ট্র্যাভেল কোম্পানির ব্যবস্থাপক প্রবীর বিশ্বাস। সেই সঙ্গে মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবসাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। মারকুইস স্ট্রিটের কারেন্সি এক্সচেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মোহাম্মদ ইন্তেজার জানান, “আমরা পুরোপুরি বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। এখন ব্যবসা চালিয়ে নেওয়াই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরাও বিপাকে
কলকাতার অনেক ছোট ও মাঝারি রেস্তোরাঁ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বড় রেস্তোরাঁগুলোর আয়ে ৫০ শতাংশেরও বেশি পতন ঘটেছে। ‘রাঁধুনি’ নামের একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁর মালিক এন সি ভৌমিক বলেন, “আমাদের আয় কমে মাত্র ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই ধারা চলতে থাকলে রেস্তোরাঁ টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।”
পর্যটননির্ভর পেশাজীবীদের দুর্দশা
শুধু ব্যবসা নয়, পর্যটননির্ভর বিভিন্ন পেশার মানুষদের জীবনও হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। হোটেল কর্মী, পর্যটক গাইড, রাঁধুনি, গাড়িচালক থেকে শুরু করে হোম-স্টে অপারেটররাও আয় হারিয়ে বেকায়দায়। এলিয়ট রোডের বাসিন্দা ফারহান রসুল বলেন, “কোভিড-পরবর্তী সময়ে চাহিদা দেখে আমি দুটি গাড়িতে বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন মাসে মাত্র পাঁচ-ছয়টি বুকিং হয়। অথচ কিস্তি দিতে হয় দেড় লাখ রুপি।”
সমাধানের আহ্বান: সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের দাবি
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোভিডের পর ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই এই সংকট তাদের আরও গভীর বিপদে ফেলেছে। তারা ভারত-বাংলাদেশ সরকারের কাছে দ্রুত কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ভিসা নীতিতে পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়েছেন।