জরুরি চিকিৎসা সেবায় বাংলাদেশের দুর্বলতা নতুন করে আলোচনায়
সম্প্রতি ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে একটি সামরিক বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটার পর, বাংলাদেশের জরুরি চিকিৎসা সেবা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দুর্ঘটনার পর আহতদের হাসপাতালে নেয়ার প্রক্রিয়া, চিকিৎসার মান ও সময়ক্ষেপণ—সবই মিলিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ইমার্জেন্সি হেলথ রেসপন্স সিস্টেম।এ খবর বিবিসি বাংলার।
দুর্ঘটনার পর প্রাথমিক চিকিৎসা প্রাপ্তির জটিলতা
বিমানের ধ্বংসাবশেষ মাইলস্টোন স্কুলের একাংশে পড়ে গেলে আহত শিক্ষার্থী ও কর্মীদের প্রথমে আশেপাশের স্থানীয় হাসপাতালে নেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে বিভিন্ন বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রে স্থানান্তর করা হলেও, এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় যে সময় লেগেছে, তা আহতদের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
বিশেষ করে বার্ন ইউনিটে নেওয়া রোগীদের অনেকেই চিকিৎসার পূর্বেই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক সেবা প্রদান না করতে পারা দেশের স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বনাম বাস্তবতা
দুর্ঘটনার দিন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ছিল চরম বিশৃঙ্খলা। উৎসুক জনতা, মিডিয়া, রাজনৈতিক নেতাদের ভিড়ে হাসপাতাল চত্বর হয়ে উঠেছিল অবরুদ্ধ। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়, যা জরুরি পরিবেশের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত।
ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন বলেন, বার্ন রোগীদের ক্ষেত্রে প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যেই ফ্লুইড রিসাসিটেশন শুরু করা প্রয়োজন, না হলে সারভাইভাল রেট অনেক কমে যায়। কিন্তু সময়মতো সেবা না পাওয়ার ফলে অনেকে মারা যান।

ইমার্জেন্সি হেলথ সিস্টেমে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুর্ঘটনার পর আবারও প্রমাণিত হলো—বাংলাদেশে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা এখনো হাসপাতাল কেন্দ্রিক এবং সেই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অনেকটাই দুর্বল। জাতীয়ভাবে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার থাকলেও, এই ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে সেটি সক্রিয় হয়নি। ফলে সেনাবাহিনী ও চিকিৎসা বিভাগ আলাদাভাবে কাজ করেছে, যা সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি করেছে।
স্বাস্থ্যখাতে পেশাদার ইমার্জেন্সি রেসপন্সের অভাব
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান জানান, দেশে এখনো ইমার্জেন্সি চিকিৎসা বিষয়ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কাঠামো গড়ে ওঠেনি। ফলে এই খাতে প্রশিক্ষিত পেশাজীবী এবং বিশেষজ্ঞ নার্সের সংকট রয়েছে।
তিনি বলেন, “শুধু হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া নয়, দুর্ঘটনাস্থলেই চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।” সেই লক্ষ্যেই এখন “ইমার্জেন্সি হেলথ প্রফেশনাল” তৈরির পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে দক্ষতা বাড়ানো যায়।
হাসপাতাল নির্ভরতা এবং স্থানান্তর সমস্যা
বর্তমানে দেশের মানুষকে নির্ভর করতে হয় কিছু নির্দিষ্ট হাসপাতালের ওপর, বিশেষ করে ঢাকার বড় হাসপাতালগুলো। এতে দেখা যায়, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা ততটা কার্যকর নয়।
প্রশিক্ষণহীনতা, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতির অভাব, এবং যোগাযোগের সমস্যার কারণে অনেক সময় রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে আরেকটিতে স্থানান্তর করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় মূল্যবান সময় নষ্ট হয়, যা জীবনহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জরুরি পরিস্থিতিতে সমন্বিত প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও সম্পূর্ণভাবে সংগঠিত নয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সমন্বয়ের অভাব এবং কেন্দ্রীয় চিন্তাভাবনার ফলে জরুরি চিকিৎসা কাঠামো কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতাল ভিত্তিক চিন্তার বাইরে যেতে হবে এবং ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, সেনাবাহিনী, রেড ক্রিসেন্টসহ সব সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করতে হবে।”

প্রাকৃতিক দুর্যোগে সক্ষমতা, স্বাস্থ্যখাতে কেন নয়?
বাংলাদেশ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারলেও, স্বাস্থ্যখাতে সেইরকম দ্রুত রেসপন্স সিস্টেম গড়ে ওঠেনি।
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, “স্বাস্থ্যখাতে ইমার্জেন্সি রেসপন্স অনেকটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও চিকিৎসকের আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করে থাকে।” অথচ উন্নত দেশগুলোতে দুর্ঘটনার মুহূর্ত থেকেই চিকিৎসা শুরু হয়, যাতে মৃত্যু কমানো যায়।
সামনের পথ: কাঠামোগত ও মানবসম্পদ উন্নয়ন
এই দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে—বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসা খাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন। শুধু বড় শহরে নয়, উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোকেও প্রস্তুত করতে হবে।
এছাড়া প্যারামেডিক কর্মী, এ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা, হেলিকপ্টার অ্যাক্সেস, এবং মোবাইল মেডিকেল টিম গঠনের দিকেও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
এখনই পদক্ষেপ জরুরি
মাইলস্টোন স্কুল দুর্ঘটনা একটি তীব্র সতর্কবার্তা। এটি দেখিয়েছে, দেশের জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনো কতটা অনভিপ্রেত ও দুর্বল। সরকার, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন এবং জনগণ—সব পক্ষকেই সম্মিলিতভাবে একটি কার্যকর ও আধুনিক জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনায় আরও মূল্যবান প্রাণ ঝরে যেতে পারে, যেগুলো সময়মতো চিকিৎসা পেলে হয়তো রক্ষা করা সম্ভব হতো।