নেপাল এখন যেন এক অভূতপূর্ব অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। জেন জি প্রজন্মের তরুণদের বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ ঘিরে পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। এই পদত্যাগের পরও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি, বরং বিক্ষুব্ধ তরুণরা আরও উগ্র হয়ে উঠেছে। পার্লামেন্ট ভবন, মন্ত্রীদের বাড়ি, এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনও আগুনে জ্বলছে।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ: সংকটের নতুন অধ্যায়
কেপি শর্মা ওলি চতুর্থবারের মতো নেপালের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে নানা সমালোচনা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত জেন জি বিক্ষোভই তার বিদায়ের কারণ হলো। রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, সাংবিধানিক পথে সংকট সমাধানের পথ তৈরি করতেই তিনি পদত্যাগ করছেন।
রাষ্ট্রপতির দপ্তর জানিয়েছে, নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত ওলিকেই অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্বে থাকতে বলা হয়েছে। তবে এখনো স্পষ্ট নয়, কে হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
আগুনে জ্বলছে পার্লামেন্ট ও নেতাদের বাড়িঘর
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর ক্ষুব্ধ জনতা সিংহ দরবার এলাকায় ঢুকে সরকারি ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। পার্লামেন্ট ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। শুধু তাই নয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা, পুস্প কমল দাহাল এবং কেপি শর্মা অলির বাড়িতেও আগুন ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
কাঠমান্ডুর বাইরে পোখরা ও বিভিন্ন শহরেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশাসনিক ভবনগুলোতে হামলার পাশাপাশি রাস্তায় দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পুলিশের উপস্থিতি অনেক জায়গায় না থাকায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কে রয়েছে।
রক্তাক্ত সংঘর্ষ: নিহত ২২, আহত শতাধিক
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে শতাধিক। নিহতদের মধ্যে এক কিশোরও রয়েছে। সোমবার রাতে পুলিশ গুলি চালালে হতাহতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, সোমবারের ঘটনায় নিহত হয় ১৯ জন, মঙ্গলবার সকালে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুতে টিয়ার গ্যাস, জলকামান, রাবার বুলেট ছোঁড়া এবং লাঠিচার্জের মতো কঠোর ব্যবস্থা নেয় পুলিশ।
জেন জি প্রজন্মের ক্ষোভের মূল কারণ
এই বিক্ষোভের সূত্রপাত সরকারের সিদ্ধান্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার)সহ ২৬টি প্ল্যাটফর্ম হঠাৎ করে নিষিদ্ধ করা হয়। সরকার দাবি করে, ভুয়া খবর ও অনলাইন প্রতারণা রুখতেই এই পদক্ষেপ।
কিন্তু নেপালের তরুণ প্রজন্মের জন্য সামাজিক মাধ্যম শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং খবর, ব্যবসা এবং যোগাযোগের প্রধান ভরসা। নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নামে। এরপর দুর্নীতি ও সরকারের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার বিরুদ্ধেও তারা আন্দোলন শুরু করে।
বিক্ষোভে নতুন মোড়
বিক্ষোভকারীরা শুধু রাস্তায় নেমে আসেনি, বরং রাজনৈতিক প্রতীকগুলোকেই লক্ষ্য করেছে। তারা সংসদ ভবনে আগুন লাগিয়েছে, সরকারের জরিপ দপ্তরের বাইরের অংশ পুড়িয়ে দিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করেছে।
এমনকি নেপালের ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির সভাপতি রবি লামিছানেকে জেল ভেঙে মুক্ত করেছে বিক্ষোভকারীরা। সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সরকারের সঙ্কট মোকাবিলা ও সেনাবাহিনীর সতর্কবার্তা
মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। কিন্তু ততক্ষণে আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। রাজধানীতে কারফিউ জারি করা হলেও তা ভেঙে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।

নেপালের সেনাবাহিনী সতর্ক করে জানিয়েছে, যদি পরিস্থিতি এভাবেই চলতে থাকে, তবে তারা সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিতে বাধ্য হবে। এদিকে দেশটির প্রধান বিমানবন্দর ত্রিভুবন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, স্থগিত করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলও।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে সংকট
বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু সামাজিক মাধ্যম নয়, সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাবই মূলত এই ক্ষোভের কারণ। নেপালের মানুষ বছরের পর বছর ধরে পরিবর্তনের আশা করছিল, কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের হতাশ করেছে।
বিবিসির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সম্পাদক আনবারাসন ইথিরাজন মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও মন্ত্রীদের পদত্যাগেও ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। বরং এই আন্দোলন দেশের গভীর রাজনৈতিক সংকট ও জনগণের আস্থাহীনতার প্রতিফলন।
শেষকথা: অনিশ্চয়তার ছায়া নেপালে
প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগ নেপালে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করলেও পরিস্থিতি মোটেও স্থিতিশীল হয়নি। আগুন, ধ্বংস আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে দেশটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে।
জেন জি প্রজন্মের তরুণরা এখন শুধু সামাজিক মাধ্যমের স্বাধীনতা নয়, বরং দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার দাবি করছে। নেপাল কি এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে, নাকি আরও গভীর অস্থিরতার দিকে যাবে—সেটিই এখন সবার বড় প্রশ্ন।