নেপালজুড়ে চলা তীব্র ছাত্র-যুব বিক্ষোভের মুখে অবশেষে নেপাল সরকার সমাজমাধ্যমের উপর থেকে ২৬টি প্ল্যাটফর্মের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন জেলায় ছাত্র ও তরুণদের লাগাতার বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির পর সরকারের এই সিদ্ধান্ত পরিস্থিতিকে নতুন মোড় দিয়েছে।
নেপাল সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও সামাজিক অস্থিরতার শুরু
গত সপ্তাহে নেপাল সরকার ২৬টি জনপ্রিয় সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সরকার দাবি করে, কিছু সমাজমাধ্যমে এমন পোস্ট ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল যা নেপালের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করছিল।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে ‘জেন জ়ি’ প্রজন্মের ছাত্র ও যুবকরা, ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সোমবার সকাল থেকেই কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষোভ শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে, শহরজুড়ে ট্রাফিক অচল হয়ে পড়ে এবং দ্রুতই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
বিক্ষোভকারীদের প্রধান দাবি: নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ
বিক্ষোভকারীরা শুধুমাত্র সমাজমাধ্যমের স্বাধীনতা নয়, প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগও দাবি করেন। ছাত্র-যুবদের মতে, সরকারের এই একতরফা সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আঘাত।
বিক্ষোভ চলাকালীন এক পর্যায়ে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর পৈতৃক বাড়িতে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। একই সঙ্গে বিরোধী দল রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টিও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও রক্তাক্ত সংঘর্ষ
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নেপাল প্রশাসন কার্ফু জারি করে এবং বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করে। তবে সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি।
পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে ১৯ তরুণ প্রাণ হারিয়েছেন এবং ২৫০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
এই সহিংসতার মধ্যে পদত্যাগ করেন নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক। সরকারের ভেতরেই মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জরুরি মন্ত্রিসভা বৈঠক ও সরকারের বড় সিদ্ধান্ত
রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ক্রমবর্ধমান ছাত্র-যুব বিদ্রোহের চাপে সোমবার রাতে জরুরি মন্ত্রিসভা বৈঠক ডাকে নেপাল সরকার। বৈঠকের পর সরকার ঘোষণা করে,
“দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে সমাজমাধ্যমের উপর থেকে ২৬টি প্ল্যাটফর্মের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলো।”
যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুং তরুণদের উদ্দেশে বিক্ষোভ প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন, সরকারের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না; বরং জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে নেওয়া হয়েছিল।
সমাজমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা কেন আরোপ করা হয়েছিল
মন্ত্রিসভার এক সদস্য জানিয়েছেন, কয়েকটি সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে জাতীয় সার্বভৌমত্বকে অসম্মানজনক মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। সরকারের দাবি, এই মন্তব্য ও পোস্টগুলো বিভাজনমূলক উস্কানি ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
তবে সরকার এটিও স্পষ্ট করেছে যে, তরুণদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানো ও সহিংসতা কমানোর জন্য আপাতত এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে
সরকার ঘোষণা করেছে, সমাজমাধ্যমে যে ধরনের হিংসা, উস্কানি ও হত্যার প্রচার হয়েছে, তার বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট ১৫ দিনের মধ্যে জমা দিতে হবে।
এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে সমাজমাধ্যম নীতিমালায় বড় পরিবর্তন আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্লেষণ: নেপালের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও তরুণদের শক্তি
এই ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে, নেপালের তরুণ প্রজন্ম এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। ‘জেন জ়ি’ প্রজন্ম শুধু ডিজিটাল স্বাধীনতা নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার।
সরকারের জন্য এটি স্পষ্ট বার্তা— জনমত উপেক্ষা করা এখন আর সম্ভব নয়। একই সঙ্গে এই সংকট নেপালের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।