অকাল বার্ধক্য অনেকের কাছেই এক আতঙ্কের নাম। কারও ৩০ বছর বয়সেই মুখে বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আবার কেউ ৯০ বছর বয়সেও তরুণের মতো ত্বক ধরে রাখতে সক্ষম হন। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যের রহস্য অবশেষে উদঘাটন করেছেন আমেরিকার কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Colorado Boulder) গবেষকেরা। তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, অকাল বার্ধক্যের জন্য দায়ী ৪০০-রও বেশি জিন ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করা গেছে।
মুখের রেখায় নয়, বার্ধক্য লুকিয়ে আছে জিনে
মানুষের বার্ধক্য মুখের ভাঁজে নয়, বরং শরীরের জিনের গঠনে ধরা পড়ে। নেচার জেনেটিক্স (Nature Genetics) জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, জিনের সক্রিয়তার কারণেই কম বয়সে বার্ধক্য নেমে আসে শরীরে। ফলে ত্বকে দেখা দেয় প্রিম্যাচিওর রিঙ্কলস বা অকাল বলিরেখা।
গবেষকেরা জানিয়েছেন, ওই জিনগুলির প্রভাবেই কারও শরীর দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়, কেউ বা অল্প বয়সেই ডায়াবেটিস, অ্যালঝাইমার্স কিংবা বাতের মতো রোগে আক্রান্ত হন। অন্যদিকে, অনেকের বার্ধক্য আসতে দেরি হয়, এমনকি ৯০ বছর বয়সেও তাঁরা তরুণদের মতো ফিট থাকেন।
জিন এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের সংযোগ
কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, ৪০৮টি জিন বার্ধক্য প্রক্রিয়ার মূল নিয়ন্ত্রক। এই জিনগুলিই নানা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা যেমন—
- ডায়াবেটিস
- অ্যালঝাইমার্স
- বাত
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস
- ঘন ঘন ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়া
এসব সমস্যার মূলে রয়েছে। জিনগুলির সক্রিয়তা অনুযায়ীই মানুষের দেহে বার্ধক্যের গতি দ্রুত বা ধীর হয়।
সাতটি গোত্রে ভাগ করা জিন
গবেষকেরা “Geroscience Hypothesis” মেনে এই জিনগুলিকে সাতটি গোত্রে ভাগ করেছেন। প্রতিটি গোত্র বার্ধক্যের আলাদা আলাদা প্রক্রিয়া যেমন কোষের অবক্ষয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দুর্বলতা বা স্মৃতিশক্তির হ্রাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। দলের প্রধান গবেষক ইসাবেল ফুট (Isabelle Foote) জানিয়েছেন, এই আবিষ্কার চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্য এক বড় সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
কীভাবে মাপা হয় বার্ধক্য?
আমেরিকায় চিকিৎসকেরা ৩০টি সূচক ব্যবহার করে বয়সজনিত দুর্বলতা মূল্যায়ন করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
- হাঁটার গতি
- ওজন তোলার সক্ষমতা
- গ্রিপ বা শক্ত করে ধরার ক্ষমতা
- স্নায়বিক দক্ষতা
- স্মৃতিশক্তি
তথ্য বলছে, ৬৫ বছর বয়সে পৌঁছে মার্কিন নাগরিকদের প্রায় ৪০ শতাংশই দুর্বলতায় আক্রান্ত হন।
টেলোমেয়ার: বার্ধক্যের আসল চাবিকাঠি
মানব শরীরের প্রতিটি কোষে থাকে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম। এই ক্রোমোজোমে থাকা ডিএনএ’র লেজকে টেলোমেয়ার বলা হয়। মানুষের বয়স যত বাড়ে, টেলোমেয়ার তত ছোট হতে থাকে। এই ক্ষয়ই মূলত বার্ধক্যের অন্যতম প্রধান কারণ।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, যদি টেলোমেয়ারের ক্ষয় রোধ করা যায়, তবে অনেকটাই বিলম্বিত করা সম্ভব শরীরের অবক্ষয়। এই গবেষণা তাই অমরত্বের সন্ধানের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা: আয়ুষ্মান জিন
আমাদের দেহকোষের ডিএনএ সারাক্ষণ বিভাজিত হয়। তাই অত্যাধুনিক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে এমন জিন তৈরি করা সম্ভব হতে পারে, যা অকাল বার্ধক্য রোধ করবে। গবেষকেরা আশাবাদী, এই আবিষ্কার থেকেই তৈরি হতে পারে “আয়ুষ্মান জিন”, যা মানুষের আয়ু বাড়াতে এবং দীর্ঘদিন সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
উপসংহার
অকাল বার্ধক্য কেবল সৌন্দর্য নয়, বরং স্বাস্থ্যঝুঁকিরও প্রতীক। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রমাণ করেছে, বার্ধক্য মূলত জিননির্ভর। তাই আগামী দিনে এই জিন গবেষণাই হয়তো এনে দেবে বার্ধক্য রোধের নতুন সমাধান। প্রশ্ন হচ্ছে—মানুষ কি তবে একদিন প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে দীর্ঘায়ুর গোপন রহস্য খুঁজে পাবে?