রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আমরা যতই জানি, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কিছু অধ্যায় রয়ে গেছে রোমাঞ্চকর ও কম আলোচিত। এর মধ্যে অন্যতম হলো তাঁর বিয়ের কাহিনি। ঠাকুরবাড়িতে সাধারণত ছেলেদের অল্প বয়সেই বিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক ব্যতিক্রম। বয়স ২৩ পার হলেও তাঁর জন্য উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তখনই পরিবারের সিদ্ধান্তে শুরু হয় কনে খোঁজার এক ঐতিহাসিক যাত্রা—গন্তব্য যশোর।
১৮৮৩ সালের সেই সময়, ঠাকুর পরিবারের সদস্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর স্ত্রী কাদম্বরী দেবী এবং আত্মীয়া জ্ঞানদানন্দিনী দেবী একসাথে যশোরের পথে রওনা দেন। তাঁদের গন্তব্য ছিল নরেন্দ্রপুর, যা ছিল জ্ঞানদানন্দিনীর পৈত্রিক গ্রাম।
রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি ইন্দিরা দেবী তাঁর বই “রবীন্দ্র স্মৃতি”-তে লিখেছেন, কাকা রবির কনে খুঁজতে তাঁরা যশোর, দক্ষিণ ডিহি, চেঙ্গুটিয়া প্রভৃতি গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। আশায় বুক বেঁধে যাত্রা শুরু হলেও, প্রত্যাশা পূর্ণ হলো না।
যশোরের অনেক প্রভাবশালী পরিবারে খোঁজ চালানো হলেও, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মানানসই পাত্রী মেলেনি। বয়স, সৌন্দর্য কিংবা গুণ—কোনো দিক থেকেই তিনি কাঙ্ক্ষিত মিল পাননি। ফলে হতাশ হয়ে যাত্রা থামল, আর ফিরতে হলো কলকাতায়। যেন যশোর সেদিন হয়ে উঠেছিল “কনের মরুভূমি”।
ফেরার পরই ঘটে যায় মোড় ঘোরানো ঘটনা। কলকাতায় ঠাকুর পরিবারের কাছারি বাড়িতে কর্মরত ছিলেন বেনীমাধব রায় চৌধুরী। তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা ভবতারিনী, যিনি পরে মৃণালিনী দেবী নামে পরিচিত হন, তাকেই রবীন্দ্রনাথের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেওয়া হলো।
রবীন্দ্র গবেষক প্রভাত মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, যশোর যাত্রার আসল উদ্দেশ্য ছিল পীরালি পরিবারের মধ্যে থেকে পাত্রী নির্বাচন করা। শেষমেশ বেনীমাধবের কন্যা ভবতারিনীই হয়ে ওঠেন সেই নির্বাচিত কনে।
সে সময়ে প্রথা ছিল কনের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই প্রস্তাব দেন যে, পাত্রী আসবেন পাত্রের বাড়িতে। অর্থাৎ, বিয়ে হবে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। তাঁর এই সিদ্ধান্ত অনেকের কৌতূহল জাগালেও, শেষ পর্যন্ত বিয়ের আয়োজন হয় তাঁর মত অনুযায়ী।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বিয়ের সমস্ত খরচ বহন করেন। হিসাব অনুযায়ী, পথ্য খরচ: ৬০ টাকা, বাড়ি ভাড়া: ২২ টাকা তিন পাই, এই খরচের বিবরণ আজও ঠাকুরবাড়ির ক্যাশবইয়ে সংরক্ষিত।
রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর বন্ধুদের হাতে লেখা নিমন্ত্রণপত্র পাঠান, যেখানে স্নেহভরে তাঁদের উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।
বিয়েতে ব্রাহ্ম ধর্মীয় কোনো আচার মানা হয়নি। বরং যশোর-খুলনার প্রচলিত হিন্দু বিবাহরীতি মেনে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। হয়তো এর মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ দেখাতে চেয়েছিলেন যে, সমাজের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে গিয়েও ভিন্ন রীতি অনুসরণ করা সম্ভব।
বিয়ের মাত্র নয় দিন পর ‘সাধারণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় একটি সংবাদ। সেখানে লেখা ছিল—
“গত রবিবারে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠপুত্র শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভ বিবাহ অতি সমারোহের সহিত সুসম্পন্ন হইয়াছে। পাত্রীটিকে যশোর হইতে আনা গিয়াছে।”
এই একটিমাত্র বাক্য থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের বিয়ের মাধ্যমে ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে যশোরের আত্মীয়তার সূচনা হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বিবাহ শুধু ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, বরং এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধ্যায়। যশোর ভ্রমণ, পাত্রী খোঁজা, প্রথা ভাঙা এবং নতুন আত্মীয়তার সূত্রপাত—সবকিছু মিলে এটি ইতিহাসের এক অমূল্য অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে যশোরের সম্পর্ক এভাবেই স্থায়ীভাবে জড়িয়ে যায়, আর সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের জীবনযাত্রায় শুরু হয় নতুন অধ্যায়।
👉 এই বিয়ের কাহিনি আজও শুধু রোমান্টিক নয়, ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা এক অমূল্য দলিল।
✍️ জীবনী ও তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ০২ সেপ্টেম্বর- ২০২৫