সরকার পরিবর্তনের এক বছরে যবিপ্রবিতে ফের পুরোনো অনিয়মের ছায়া
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছর না যেতেই যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) যেন পুরোনো ছকে ফিরছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অঙ্গনে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে সেই পুরোনো সিন্ডিকেট, যারা বিগত সময়ে অর্গানোগ্রাম ছাড়াই অবৈধ নিয়োগ এবং অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, যবিপ্রবির সাবেক রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীব, যিনি অবসরে যাওয়ার পরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, তিনিই এই পুরোনো সিন্ডিকেটের মূল নেতা। তাঁর চারপাশে আবার জড়ো হয়েছেন কিছু বিতর্কিত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা।
অর্গানোগ্রাম ছাড়া নিয়োগ: নিয়মের বাইরে বিশাল আয়োজন
২০১৯-২০ অর্থবছরে যবিপ্রবির অনুমোদিত অর্গানোগ্রামের মেয়াদ শেষ হয়। পরবর্তীতে নতুন অর্গানোগ্রাম প্রণয়ন ও অনুমোদনের জন্য ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলেও তা চূড়ান্ত হয়নি। এই অননুমোদিত অবস্থাতেই একের পর এক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়, যা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত।
এ সময় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বাছাই প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা নির্ধারণেও ছিল চরম স্বজনপ্রীতির ছাপ। অভিযোগ রয়েছে, যারা প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ, তাদের জন্য বিশেষ শর্ত যুক্ত করে বিজ্ঞপ্তি তৈরি করা হতো।
প্রভাবশালীদের আশীর্বাদে ল’ অফিসারের নিয়োগ
২০২৩ সালের ২২ আগস্ট যবিপ্রবিতে মাহমুদ আশরাবী নিশান নামক একজনকে ল’ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ তাঁর যোগ্যতা সহকারী রেজিস্ট্রার (লিগ্যাল) পদের জন্য যথেষ্ট না হওয়ায়, তাঁকে সেই পদে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেখানো হয়। জানা যায়, তার পিতা অ্যাডভোকেট তজিবর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন উপদেষ্টা এবং রেজিস্ট্রার আহসান হাবীবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
এই নিয়োগ ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি হলে তজিবর রহমান পদত্যাগ করেন, কিন্তু ছেলের চাকরি বহাল থাকে। এমনকি রেজিস্ট্রারের ঘনিষ্ঠজন, আত্মীয়-স্বজনদেরও অনিয়মিতভাবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
৬১ লাখ টাকার আত্মসাত ও দুদকের মামলা
২০২৩ সালের আগস্টে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যবিপ্রবির সাবেক উপাচার্য ড. আব্দুস সাত্তার, উপ-উপাচার্য ড. কামাল উদ্দিন এবং উপ-পরিচালক আব্দুর রউফের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করে। এই মামলায় সাবেক উপাচার্য ড. সাত্তার বর্তমানে কারাগারে, কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্ত আব্দুর রউফ এখনো পদে বহাল।
দুদকের আইন অনুযায়ী চার্জশিটভুক্ত আসামিকে সাময়িক বরখাস্ত করা বাধ্যতামূলক হলেও, যবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ এখনও সে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
রেজিস্ট্রার আহসান হাবীব: পুরোনো সিন্ডিকেটের মূল চালক?
প্রকৌশলী আহসান হাবীব ২০১১ সালে যে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ পান, সেখানে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার যে শর্ত ছিল তা তিনি পূরণ না করেই নিয়োগ পান। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন এমপি খালেদুর রহমান টিটোর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তিনি এই সুযোগ পান।
তাঁর নেতৃত্বেই বিগত এক যুগে যবিপ্রবিতে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ঘটেছে। দুইজন উপাচার্য পরিবর্তিত হলেও তিনিই রেজিস্ট্রার পদে বহাল ছিলেন এবং বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। তার ঘনিষ্ঠজনদের নিয়োগ, এবং এবার নিজের ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার গুঞ্জনও চলছে।
তদন্ত কমিটি: পাঁচ মাসেও কাজ শুরু হয়নি!
যবিপ্রবির লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক উপাচার্য ড. রফিকুল ইসলাম সরকারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু পাঁচ মাস পার হলেও কমিটি কার্যক্রম শুরু করেনি।
ড. রফিকুল ইসলাম সরকার জানান, তিনি সম্প্রতি তদন্তের কাগজপত্র পেয়েছেন এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কমিটি কাজ করছে এবং বিষয়টি সময়সাপেক্ষ।
রেজিস্ট্রারের বক্তব্যের অনুপস্থিতি
যবিপ্রবির রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীবের বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকলেও কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না, কারণ পূর্বে যাঁরা অভিযোগ করেছিলেন, তাঁদের চাকরি জীবনে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
উপাচার্যের প্রতিশ্রুতি: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান
বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মজিদ জানিয়েছেন, যবিপ্রবির যেকোনো অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, রেজিস্ট্রারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ শুধুমাত্র প্রশাসনিক কার্যক্রম সচল রাখার জন্য। নিয়োগ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিও ইতোমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে।তিনি আশ্বস্ত করেন, দুদকের মামলায় অভিযুক্ত আব্দুর রউফের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং ল’ অফিসারের নিয়োগ বিষয়টি তদন্ত কমিটি দেখছে।