শৈশব ও শিক্ষা জীবন
মোঃ আনসার উদ্দিন বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি এ্যাথলেটিক, ফুটবল, হ্যান্ডবল ও হকি খেলায় অসাধারণ সাফল্যের পাশাপাশি একজন সংগঠক, প্রশিক্ষক ও নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ২০শে ডিসেম্বর, যশোর শহরের স্টেডিয়াম রোডে। পিতা ছিলেন ডাঃ আলী আহমেদ। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। শিক্ষাজীবনে তিনি যশোর সিটি কলেজ থেকে আইএ (ইন্টারমিডিয়েট) পাস করেন।
শুরুটা ক্রীড়াক্ষেত্রে – একজন প্রতিভাবান এ্যাথলেট
জেলা স্কুলে পড়াশোনার সময়েই আনসার উদ্দিন তাঁর অ্যাথলেটিক প্রতিভা দিয়ে সবার নজর কাড়েন। তিনি উচ্চলাফ এবং সাঁতারে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৬২-৬৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে বাটার ফ্লাই সাঁতারে রৌপ্য পদক লাভ করা।
ফুটবল ও হকিতে সফলতা
ফুটবল খেলায় তিনি ছিলেন যশোর জেলা স্কুলের পক্ষে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন। হকিতে ১৯৬২ ও ১৯৬৩ সালে জাতীয় পর্যায়ে দুইবার রানার্স আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। যশোর শহরের জনপ্রিয় ক্লাবসমূহ—ইস্টার্ণ ক্লাব ও মুসলিম ক্লাবের হয়ে তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ফুটবল খেলেন।
ক্রীড়া সংগঠক ও প্রশিক্ষকের আত্মপ্রকাশ
মাত্র ১৫ বছর বয়সেই (১৯৬১ সালে) তিনি ক্রীড়া সংগঠক ও প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর বহুমাত্রিক ক্রীড়াজীবন তাঁকে শুধু খেলোয়াড় নয়, বরং দক্ষ কোচ ও সংগঠক হিসেবে গড়ে তোলে। তিনি ছিলেন একজন স্কাউট, যিনি সিলেট, চট্টগ্রাম এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে বিশ্ব জাম্বুরীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
শিক্ষাগত ক্রীড়া প্রশিক্ষণ ও কোচিং জীবন
তিনি ১৯৬৯ সালে মোহাম্মদপুর শরীরচর্চা কলেজ থেকে বিপিএড (B.P.Ed) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ১৯৭৮ সালে ভলিবলের কোচ এবং ১৯৮৭ সালে হ্যান্ডবলের কোচ হিসাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও তিনি বক্সার হিসেবেও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং স্কুল জীবনে আর্মি ক্যাডেট প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
শিক্ষকতা ও ছাত্রছাত্রীদের ক্রীড়া উন্নয়নে অবদান
কর্মজীবনে তিনি যশোর এমএসটিপি গার্লস স্কুলে শরীরচর্চার শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর দক্ষ প্রশিক্ষণে তৈরি হন বহু কৃতি ক্রীড়াবিদ। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম হলো—
- আসমা, শিরীন, সালমা – এ্যাথলেটিকসে কৃতিত্বের অধিকারী।
- নাহার, রোজালিন – হ্যান্ডবলে জাতীয় পর্যায়ে খেলা ক্রীড়াবিদ।
তিনি যশোর জেলার পুলেরহাট, হাসিমপুর ও এমএসটিপি গার্লস স্কুলে হ্যান্ডবল খেলার প্রচলন ঘটান, যা স্থানীয় ক্রীড়া আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে।
যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও জাতীয় এ্যাথলেটিকস ইভেন্টে ভূমিকা
তিনি “যশোর জেলা ক্রীড়া সংস্থা”র এ্যাথলেটিকস ও সাঁতার উপ-পরিষদের সদস্য হিসেবে বহুবার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে জাতীয় এ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ফিল্ড ডিসপ্লের প্রধান এবং দ্বিতীয় জাতীয় এ্যাথলেটিকস ইভেন্টে প্রধান বিচারক হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
দিশারী ক্লাব: সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদচারণা
১৯৬৭ সালে মোঃ আনসার উদ্দিন প্রতিষ্ঠা করেন “দিশারী ক্লাব”, যা যশোর শহরের অন্যতম সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠন। তিনি শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠাতা নন, ক্লাবের বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করেছেন এবং সংগঠনের সাংস্কৃতিক পরিসরে সক্রিয় থেকেছেন।
ব্যাণ্ড শিক্ষক ও ব্যাণ্ড মাস্টারের দায়িত্ব
জেলা স্কুলে পড়াকালীন তিনি ব্যাণ্ড মাস্টার এবং পরবর্তীকালে স্কুল ব্যাণ্ডের শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন, যা প্রমাণ করে যে তিনি ক্রীড়া ও সংস্কৃতির অনন্য মেলবন্ধনে একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব।
একজন অনুপ্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব
মোঃ আনসার উদ্দিন শুধুমাত্র একজন খেলোয়াড় ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী সংগঠক, আদর্শ শিক্ষক এবং নিবেদিত প্রশিক্ষক। তাঁর বহু ছাত্রছাত্রী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করেছে। যশোর জেলার ক্রীড়া জগতের উন্নয়নে তাঁর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
✍️ জীবনী ও তথ্যসংগ্রহ: সাজেদ রহমান | যশোর 📅 প্রকাশকাল: ৬ আগস্ট ২০২৫