যশোরে নাট্য মঞ্চে জীবন্ত হয়ে উঠলো ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান
যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দড়াটানা ভৈরব নদের পাদদেশ সোমবার বিকালে পরিণত হয়েছিল প্রতিরোধের মঞ্চে। যেখানে মাত্র ১৭ মিনিটের নাটক ‘জুলাই জ্বলে উঠুক’-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ফুটিয়ে তুলেছে ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোর ইতিহাস ও ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা।
এই নাট্য পরিবেশনার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকারের দমনপীড়নের ভয়াবহ রূপ, জনগণের প্রতিরোধ, আন্দোলনের গতি ও পরিণতি—সবকিছুই নিখুঁতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
নাট্য পরিকল্পনা ও আয়োজনে উদ্ভাবনী চিন্তার ছাপ
নাটকটির নির্দেশক সোহানুর রহমান সোহাগ জানান, যশোর জেলা পরিষদের আয়োজনে আয়োজিত আইডিয়া প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই নাটকটি নির্বাচন করা হয়। এতে যেমন উঠে আসে একটি ফ্যাসিবাদবিরোধী গণ-আন্দোলনের চিত্র, তেমনি তারুণ্যের স্বপ্ন, সাহস ও সংগঠনের শক্তিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নির্দেশকের ভাষ্য অনুযায়ী:
“জুনের শুরুতে বৈষম্যের শেকল ছেঁড়ার আকুলতা, সমতার দাবিতে যে আগুন জমেছিল, তা জুলাইয়ে রূপ নেয় এক বিশাল দাবানলে।”
নাটকটিতে শহরের রাজপথে মিছিল, গলিতে স্লোগান, তরুণদের জেগে ওঠা এবং রাষ্ট্রীয় দমন নীতির রূঢ়তাকে অত্যন্ত শিল্পিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গি: ইতিহাস থেকে ভবিষ্যতের প্রেরণা
এই নাটক কেবল এক ঐতিহাসিক ঘটনা পুনঃউপস্থাপন নয়, এটি তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক সচেতনতার প্রতিচ্ছবি। নাট্যকারদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল—ফ্যাসিবাদকে শুধুই ইতিহাসে সীমাবদ্ধ না রেখে, সেটিকে চিরকালীন সতর্কতা ও প্রতিরোধের বার্তা হিসেবে তুলে ধরা।
নাটকে উঠে আসে—কিভাবে পুলিশ বাহিনী, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় রক্তাক্ত হয়েছিল ছাত্র জনতা, কিভাবে তারা শহরের অলিগলি স্লোগানে মুখরিত করেছিল এবং শেষে কীভাবে তারা সফলভাবে ফ্যাসিবাদী সরকার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করে।
ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের কাহিনি নাটকে জীবন্ত রূপ পায়
নাটকের অন্যতম শক্তিশালী দিক ছিল ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের চিত্রায়ন। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন, তাদের কিছু জীবন দিয়েছেন, কিছু কারাবরণ করেছেন, কিন্তু পিছিয়ে যাননি।
এই নাটক সেই বীরত্বের কাহিনি, সেই সাহসী প্রতিরোধের গান—যেখানে প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি মঞ্চায়ন ছিল একটি ইতিহাসের দলিল।
মঞ্চস্থ স্থান ও পরিবেশ: স্মৃতির আবেশ ও আন্দোলনের ছোঁয়া
ভৈরব নদের পাড়ে পার্কের মনোরম পরিবেশে মঞ্চস্থ এই নাটক যেন ইতিহাসের সাথে প্রকৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল। ভিড় করেছিলেন সাধারণ দর্শক, শহরের তরুণ-তরুণী, অভিভাবক, পথচারী—সবাই দাঁড়িয়ে নাটকটি উপভোগ করেছেন।
অনেকেই মুঠোফোনে দৃশ্য ধারণ করেছেন, যা নাটকটির তাৎপর্য এবং সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা ও আগ্রহের প্রমাণ।
১১টি স্থানে মঞ্চায়ন: একটি আন্দোলনের নাট্যভাষ্য
নাটকটির নির্দেশক জানান, গত এক মাসে যশোর জেলার ৮টি উপজেলার ১১টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ‘জুলাই জ্বলে উঠুক’ মঞ্চস্থ করা হয়েছে। এই নাটককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তরুণদের নতুন আন্দোলন চেতনা।
এটি এখন শুধু একটি নাটক নয়, বরং হয়ে উঠেছে একটি ঐতিহাসিক স্মারক যা ২০২৪ সালের আন্দোলনের মূল কথাগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছে দিতে সাহায্য করছে।
নাটকের প্রেক্ষাপট: ২০২৪ সালের বাস্তবতা ও গণচেতনার জাগরণ
২০২৪ সালের আন্দোলনের পটভূমি হিসেবে নাটকে তুলে ধরা হয়েছে—
- বেকার যুবকদের ক্ষোভ ও বঞ্চনার অভিজ্ঞতা
- রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত
- ভয়ভীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্প
- গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ছাত্র সমাজের অগ্রণী ভূমিকা
এই নাটক একটি বিপ্লবের সারাংশ—যেখানে সাহস, আত্মত্যাগ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের শেকল ভাঙার চিত্র অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
মঞ্চে ইতিহাস, মনে আন্দোলন
‘জুলাই জ্বলে উঠুক’ নাটকটি শুধুই একটি নাট্য কর্মসূচি নয়, এটি আধুনিক বাংলা রাজনৈতিক নাট্যচর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই নাটক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—ফ্যাসিবাদ বারবার ফিরে আসতে পারে, কিন্তু সচেতন নাগরিকদের ঐক্য, প্রতিবাদ ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধেই নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ।
আমরা বিশ্বাস করি, এই নাটক নতুন প্রজন্মকে গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবে, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের শক্তি উপলব্ধি করাবে এবং ভবিষ্যতের আন্দোলনের বীজ বপন করবে।