অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরে খিদে কমে যাওয়া, পেটে অস্বস্তি বা হজমের গোলযোগ—এই সমস্যাগুলি আজকাল সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই জানেন না, এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পেটের ব্যাক্টেরিয়াল ভারসাম্যের বিঘ্ন। আমরা এই প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানাব কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে প্রভাব ফেলে এবং কী উপায়ে শরীর আবারও চাঙ্গা করা সম্ভব।
অ্যান্টিবায়োটিক কীভাবে হজম ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে
অ্যান্টিবায়োটিক হল এমন একটি ওষুধ যা শরীরের ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করে অসুখ সারাতে সাহায্য করে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন এই ওষুধ শরীরের উপকারী ব্যাক্টেরিয়াগুলিকেও ধ্বংস করে দেয়। আমাদের অন্ত্রে (গাট) রয়েছে লক্ষ লক্ষ ভাল ব্যাক্টেরিয়া, যেগুলি খাবার হজম, পুষ্টি শোষণ এবং রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার ফলে এই ব্যাক্টেরিয়াগুলি কমে গেলে দেখা দেয়—
- খিদে কমে যাওয়া
- পেট ফাঁপা
- বদহজম
- কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়ারিয়া
- অস্বস্তি ও ক্লান্তিভাব
গাট হেল্থ ঠিক না থাকলে কী ধরনের সমস্যা হয়
শরীরের ইমিউন সিস্টেমের একটি বড় অংশ নির্ভর করে অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উপর। যখন গাট হেল্থের ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন শরীর বিভিন্নভাবে তার প্রতিক্রিয়া জানায়:
- ইনফ্লেমেশন বা পেটের প্রদাহ
- শক্তি কমে যাওয়া ও দুর্বলতা
- ত্বকে অ্যালার্জি বা ফুসকুড়ি
- মাথা ঘোরা বা মেজাজ খারাপ হওয়া
- ঘনঘন ঠান্ডা লাগা বা সংক্রমণ হওয়া
অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার সময় কী করবেন
১. টক দই বা গ্রিক ইয়োগার্ট খান নিয়মিত
টক দইয়ে থাকে ল্যাক্টোব্যাসিলাস, একটি উপকারী ব্যাক্টেরিয়া যা অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার সময়ে প্রতিদিন ১ বাটি টক দই খাওয়া অভ্যাস করলে হজম ক্ষমতা বাড়ে ও পেটের অস্বস্তি অনেকটাই কমে যায়।
পেয়ারে বা কলার সঙ্গে দই খেলে পুষ্টিগুণ আরও বাড়ে।
২. ফারমেন্টেড খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন খাদ্যতালিকায়
ফারমেন্টেড বা জৈবভাবে প্রস্তুত খাবারে প্রোবায়োটিক উপাদান প্রচুর পরিমাণে থাকে। নিচের কিছু খাবার পেটের জন্য খুবই উপকারী:
- ইডলি ও দোসা (চালের গাঁজন হওয়া খাবার)
- কেফির (দুধ থেকে তৈরি এক বিশেষ ধরনের ফারমেন্টেড পানীয়)
- কিমচি (জাপানি সবজি ফারমেন্ট)
- আঁচা চাল ভিজিয়ে রেখে বানানো পানীয় বা পান্তা ভাত
এই খাবারগুলি হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং গাট হেল্থ পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩. প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন চিকিৎসকের পরামর্শে
অনেক সময় চিকিৎসকেরা অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি প্রোবায়োটিক ক্যাপসুল বা পাউডার লিখে দেন। এগুলিতে থাকে বিলিয়ন ইউনিট উপকারী ব্যাক্টেরিয়া যা অন্ত্রে গিয়ে তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।
সাবধানতা: স্বনির্দেশে এই সাপ্লিমেন্ট নেওয়া ঠিক নয়। অবশ্যই চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে সঠিক মাত্রায় ও নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে।
৪. পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান করুন
জল শরীরের টক্সিন নিষ্কাশনে সাহায্য করে। দিনে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ গ্লাস জল পান করলে শরীর হাইড্রেট থাকে, গাট হেল্থ ভাল থাকে এবং পেটের সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে।
৫. চিনি, তেল ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন
অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার সময়ে অনেকেই চকলেট, সফট ড্রিঙ্ক বা প্যাকেটজাত খাবার খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এগুলিতে থাকা অতিরিক্ত চিনি, প্রিজারভেটিভ ও ট্রান্স ফ্যাট হজমে ব্যাঘাত ঘটায়। এই সময় বিশেষ করে নিচের খাবারগুলি এড়িয়ে চলুন:
- কোল্ড ড্রিঙ্ক
- চিপস ও ফাস্ট ফুড
- প্যাকেটজাত দই বা মিষ্টান্ন
- রেডি-টু-ইট স্ন্যাকস
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক নয়
আজকাল অনেকেই নিজের ইচ্ছায় অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনে খেয়ে ফেলেন, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক অভ্যাস। এতে শরীরে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়, যার ফলে ওষুধ আর কাজ করে না। এর ফলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংক্রমণ হলেও প্রতিকার পাওয়া মুশকিল হয়।
তাই মনে রাখবেন:
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক নয়
- সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করা জরুরি
- প্রতিবার অ্যান্টিবায়োটিক শুরুর আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন
অ্যান্টিবায়োটিকের পরে কীভাবে শরীর চাঙ্গা করবেন
১. হালকা ও সুষম খাবার খান
এই সময় হজমযোগ্য এবং পুষ্টিকর খাবার বেছে নেওয়া জরুরি। যেমন:
- খিচুড়ি, সুপ, ওটস
- সিদ্ধ ডিম বা সেদ্ধ মাছ
- সবুজ শাকসবজি ও মৌসুমি ফল
২. পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন
অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে ক্লান্তি বাড়াতে পারে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ও নিরবিচারে ঘুম হলে শরীর দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়।
৩. হালকা ব্যায়াম বা হাঁটা শুরু করুন
পর্যাপ্ত বিশ্রামের পরে ধীরে ধীরে হালকা এক্সারসাইজ বা হাঁটা শুরু করলে শরীরের শক্তি ও মেটাবলিজম বাড়ে। এটি অন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করে।
উপসংহার
অ্যান্টিবায়োটিকের উপকারিতার পাশাপাশি এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে যা অনেকেই এড়িয়ে যান। অন্ত্রের স্বাস্থ্য (গাট হেল্থ) ঠিক না থাকলে তা আমাদের শরীর ও মনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, পর্যাপ্ত জলপান এবং চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে ওষুধ খেলে সহজেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
👉 সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন। অ্যান্টিবায়োটিক নয় নিজের ইচ্ছায়, বরং গাট হেল্থ ঠিক রাখুন নিয়ম মেনে।