যৌবন দীর্ঘস্থায়ী করা এবং বার্ধক্য রুখে দেওয়া— মানব সভ্যতার বহু পুরনো আকাঙ্ক্ষা। আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এখন আর এই স্বপ্ন অলীক নয়। সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে একটি বিশেষ প্রোটিনকে (IL-11) নিষ্ক্রিয় রাখতে পারলেই আয়ু বৃদ্ধি সম্ভব, এমনকি বার্ধক্যও বহুটা ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে। এই গবেষণার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি সাইটোকাইন প্রোটিন: ইন্টারলিউকিন-১১ (IL-11)। গবেষকরা মনে করছেন, এই প্রোটিনই আমাদের বার্ধক্যের গতিকে ত্বরান্বিত করে এবং কোষের মৃত্যু ঘটিয়ে শরীরকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে তোলে।
IL-11 প্রোটিন: বার্ধক্যের গোপন খলনায়ক
ইন্টারলিউকিন-১১ (IL-11) হলো এক ধরনের সাইটোকাইন, যা মূলত কোষের মেরামতি ও শরীরের প্রদাহ নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই প্রোটিনের মাত্রা যদি অতিরিক্ত হয়ে যায়, তখন শরীরের অভ্যন্তরে ঘটে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। গবেষণায় দেখা গেছে—
- বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে IL-11-এর পরিমাণ বাড়তে থাকে
- অতিরিক্ত IL-11 প্রদাহের মাত্রা বাড়ায়, ফলে কোষ ধ্বংসের হারও দ্রুত হয়
- এতে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়, এবং বার্ধক্য দ্রুত এগিয়ে আসে
গবেষকদের মতে, IL-11 প্রোটিনই বার্ধক্যের পিছনের অন্যতম প্রধান কারণ। ফলে এই প্রোটিনকে নির্দিষ্টভাবে নিষ্ক্রিয় বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে জীবনের গতি বদলে দেওয়া সম্ভব।
ইঁদুরের উপর গবেষণা: চমকপ্রদ ফলাফল
লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজ এবং সিঙ্গাপুরের ডিউক-এনইউএস মেডিক্যাল স্কুল যৌথভাবে একটি গবেষণা চালিয়েছে, যার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে খ্যাতনামা জার্নাল ‘নেচার’ মেডিসিনে। এই গবেষণায় দেখা গেছে—
- একদল ৭৫ সপ্তাহ বয়সী ইঁদুরের (মানব বয়সে প্রায় ৫৫ বছর) শরীরে IL-11 বন্ধ করতে বিশেষ অ্যান্টিবডি ইনজেক্ট করা হয়
- এই অ্যান্টিবডি সাময়িকভাবে IL-11-এর কার্যকলাপকে রোধ করে
- পরীক্ষায় দেখা যায়, ইঁদুরের আয়ু ২৫ শতাংশ বেড়ে ১৫৫ সপ্তাহে পৌঁছায়, যেখানে সাধারণ ইঁদুরের আয়ু ১২০ সপ্তাহেই থেমে যায়
- শুধু আয়ু নয়, ইঁদুরগুলির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার্যক্ষমতা ও শারীরিক গঠনও স্বাভাবিক থেকে যায়, অর্থাৎ বার্ধক্যের লক্ষণ দৃশ্যত কমে যায়
মানুষের শরীরে এই গবেষণা কতটা প্রযোজ্য?
গবেষণার এই পর্যায়টি এখনও প্রাক-ক্লিনিক্যাল। অর্থাৎ, ইঁদুরে যেটি সফল হয়েছে, তা মানুষের শরীরেও একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। তাঁদের মতে—
- IL-11 সাইটোকাইন প্রোটিন মানুষের শরীরেও উপস্থিত, এবং এটি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়
- মানুষের শরীরেও অতিরিক্ত প্রদাহ, কোষ ধ্বংস, শারীরিক অবক্ষয়ের সঙ্গে এই প্রোটিনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে
- অ্যান্টিবডির মাধ্যমে IL-11-এর কার্যকলাপকে রোধ করা গেলে বার্ধক্যজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব কমে আসবে
- দীর্ঘমেয়াদে এই প্রক্রিয়া ক্যানসার, হৃদরোগ, ফাইব্রোসিস ও স্নায়বিক রোগ প্রতিরোধেও কার্যকরী হতে পারে
এই আবিষ্কারের গুরুত্ব কেন এত বেশি?
এখন পর্যন্ত বার্ধক্যকে থামানোর চেষ্টা করা হয়েছে বাহ্যিক কসমেটিক, ডায়েট বা জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু এবার বিজ্ঞানীরা বার্ধক্য ঠেকাতে সরাসরি কোষীয় ও প্রোটিন স্তরে হস্তক্ষেপের উপায় খুঁজছেন। এই গবেষণার তাৎপর্য কয়েকটি দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়—
- প্রথমবারের মতো একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ধরে বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
- শুধুমাত্র আয়ু বৃদ্ধিই নয়, যৌবন ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মক্ষমতা ধরে রাখাও সম্ভব
- ভবিষ্যতে এটি হতে পারে ‘অ্যান্টি-এজিং থেরাপি’-এর মূলে থাকা চিকিৎসা
- দুরারোগ্য ও বার্ধক্যজনিত রোগের ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে প্রতিরোধী ঢাল
বিজ্ঞানীদের পরবর্তী লক্ষ্য কী?
এই গবেষণার পরবর্তী ধাপ হলো—
- মানুষের কোষের উপর গবেষণা, যেখানে দেখা হবে অ্যান্টিবডি IL-11 কতটা কার্যকর
- সম্ভাব্য সাইড-ইফেক্ট বা বিপরীত প্রতিক্রিয়া খুঁজে বের করা
- ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়ে মানুষের শরীরে এই প্রযুক্তির সুরক্ষা ও কার্যকারিতা প্রমাণ করা
- নতুন অ্যান্টিবডি থেরাপি তৈরি করা যা বাজারে ব্যবহারের উপযোগী
কোন কোন রোগ প্রতিরোধে এটি কার্যকর হতে পারে?
IL-11 নিষ্ক্রিয় করার মাধ্যমে যে রোগগুলির ঝুঁকি কমে আসবে তা হলো—
- ফাইব্রোসিস (যকৃত, ফুসফুস, কিডনিতে)
- অস্টিওআর্থ্রাইটিস
- নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজিজ (আলঝেইমার্স, পারকিনসন)
- হৃদরোগ ও রক্তনালির প্রদাহজনিত অসুখ
- ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে
অন্তিম ভাবনা: বার্ধক্য ঠেকানো এখন আর স্বপ্ন নয়
এত দিন আমরা বয়সের ভারে নুয়ে পড়াকে মেনে নিয়েছিলাম এক প্রাকৃতিক নিয়ম বলে। কিন্তু এই নতুন গবেষণা জানিয়ে দিল—বয়সের গতি হয়তো থামানো সম্ভব নয়, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়াকে থামানো যেতে পারে। আর সেই সূত্রধর হলো মাত্র একটি প্রোটিন, IL-11। বিজ্ঞানীরা যদি এই প্রোটিনের কার্যক্রমকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন, তবে এক নতুন যুগের সূচনা হবে—যেখানে বার্ধক্য আর এক অনিবার্য ভবিষ্যৎ নয়, বরং একটি প্রতিরোধযোগ্য অবস্থা।