গুলশানের অভিজাত এলাকায় চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার চার
রাজধানীর গুলশান এলাকায় সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজির অভিযোগে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ চার নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরা হলেন – আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ, সাকাদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব ও মো. ইব্রাহিম হোসেন। রোববার (২৭ জুলাই) আদালত তাঁদের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
আদালতে ওঠানোর সময় ‘চাঁদাবাজ’ স্লোগান
চার ছাত্রনেতাকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানে উপস্থিত লোকজন ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা উচ্চস্বরে ‘চাঁদাবাজ চাঁদাবাজ’ স্লোগান দিতে থাকেন। তখন ছাত্রনেতারা মাথা নিচু করে লজ্জায় মুখ লুকান। আদালত প্রাঙ্গণে তৈরি হয় উত্তেজনা, চলে ধাক্কাধাক্কি ও স্লোগান।
চাঁদাবাজির ঘটনায় কী ঘটেছিল?
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ১৭ জুলাই সকাল ১০টার দিকে আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ ও কাজী গৌরব অপু গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডের শাম্মী আহমেদের বাসায় গিয়ে ৫০ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে বাদীকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। প্রথমবারেই বাদীকে ১০ লাখ টাকা দিতে বাধ্য করা হয়।
বারবার চাঁদার দাবি ও হুমকি
এতেই থেমে থাকেনি চক্রটি। গত ১৯ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় রিয়াদ ও অপু ফের বাড়িতে গিয়ে দরজায় সজোরে ধাক্কা মারেন। গুলশান থানা পুলিশকে জানালে তাঁরা সরে যায়। কিন্তু ২৬ জুলাই বিকেলে রিয়াদের নেতৃত্বে আরও একবার বাদীর বাসার সামনে গিয়ে বাকি ৪০ লাখ টাকা দাবি করে চক্রটি। পুলিশকে খবর দেওয়ার পর গুলশান থানা পুলিশ তাদের হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে। এ সময় অপু পালিয়ে যায়।
আদালতে উত্তপ্ত পরিস্থিতি
চার ছাত্রনেতাকে দুপুরে প্রাইভেটকারে করে সিএমএম আদালতে আনা হয়। আদালতে তোলার সময় আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বলেন, তারা কোনো চাঁদা চাননি, বরং আওয়ামী লীগের দোসররা তাদের ফাঁসিয়েছে। ইব্রাহিম হোসেন আদালতে বলেন, ‘‘আমরা চাঁদা চাইনি। আমরা থানায় ফোন করেছিলাম, কিন্তু পুলিশ তখন সাহায্য করেনি।’’
তদন্ত কর্মকর্তার রিমান্ড আবেদন
তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার পরিদর্শক মোখলেছুর রহমান আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। তিনি বলেন, ঘটনার পেছনে কোনো গডফাদার জড়িত আছে কিনা, তা খুঁজে বের করতে হবে। তাই সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে রিমান্ড অপরিহার্য।
বাদী পক্ষের কঠোর অবস্থান
বাদীপক্ষের আইনজীবী শামছুদ্দোহা সুমন আদালতে বলেন, ‘‘এরা চাঁদাবাজ চক্র। গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডির অভিজাত এলাকায় এরা চাঁদা দাবি করে বেড়ায়। তারেক রহমানের নাম নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করে চাঁদাবাজি করে। কত কোটি টাকা চাঁদা তুলেছে, তা রিমান্ডেই বের হবে।’’
বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ক্ষোভ
আদালত চত্বরে বিএনপিপন্থি কয়েকজন আইনজীবী বলেন, ‘‘যাদের এক সময় খাবার কেনার টাকা ছিল না, আজ তারা কোটি টাকার গাড়ি চড়ে। এরা আর যাই হোক, রাজনীতি করার যোগ্য নয়।’’ আসামিদের পক্ষে থাকা আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে রিমান্ডের নির্দেশ দেন।
হাজতখানায় নেওয়ার সময় হামলা
রিমান্ডের আদেশের পর আসামিদের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়ার সময় আইনজীবীরা তাঁদের দিকে তেড়ে যান। আসামিদের চড়-থাপ্পড়ও মারতে দেখা যায়। পরে পুলিশ তাদের দ্রুত আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যায়।
এক শিশুর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রেরণ
একই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া এক শিশুকে গাজীপুরের টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. শওকত আলী।
চাঁদাবাজি মামলার নতুন দৃষ্টান্ত
এ ধরনের ঘটনা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোতে চাঁদাবাজির প্রবণতা নিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এখন প্রশ্ন তুলছেন – ছাত্রনেতারা কেন কোটি কোটি টাকার চাঁদা দাবির মত অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে? রাজনৈতিক পরিচয় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আইনের চোখ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা কতদূর যাবে?
কঠোর পদক্ষেপের দাবি
এই ঘটনার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারও দলীয় ছাত্র রাজনীতির সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে মফস্বল – কোথাও যেন চাঁদাবাজ চক্র মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে, তার জন্য প্রশাসনের কাছে দৃঢ় নজরদারি ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজ।
শেষ কথা
এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি করে জনসাধারণের নিরাপত্তা, মান-সম্মান লুণ্ঠন হয়। প্রশাসনের উচিত এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে আর কোনো ছাত্রনেতা ‘চাঁদাবাজ চাঁদাবাজ’ স্লোগানে মুখ লুকাতে না বাধ্য হয়।