দুই নারী একটি ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছে। পিছনে নদী। ঝুড়িতে রয়েছে হ্যান্ড গ্রেনেড। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেয়া তাদের কাজ। মুক্তিযোদ্ধা ও আলোকচিত্রী এসএম শফি ছবিটি তুলেছিলেন ১৯৭১-এ। অসংখ্যবার এই ছবির দিকে তাঁকিয়ে থেকেছি, আর ভেবেছি, আমাদের নারীরাও মুক্তিযুদ্ধে কত না ভূমিকা রেখেছেন।
এই ছবির দুই নারীর একজন (চেক শাড়ি পরা)মুক্তিযোদ্ধা আম্বিয়া শফি। অন্যজনের নাম এখন মনে করতে পারছি না। আম্বিয়া শফি গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর সাথে আমার পরিচয় ৯০-এর দশকে। সর্বশেষ গত মাসে কথা হয়েছিল।
শহরের মোল্লাপাড়ার বাসায় যেতে বলেছিলেন-কিন্তু করনোর কারণে যায়নি। অনেক দিন তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে শুনেছি।
আম্বিয়া শফির জন্ম ১৯৫৭ সালের ৩১ শে জানুয়ারি যশোরের শার্শা উপজেলা সদরে। পিতার নাম ডাক্তার মাওলা বক্স বিশ্বাস। আম্বিয়া শফির একটি সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম গত অক্টোবর মাসে।
তিনি বলেছিলেন, আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখনই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। আমার বাবা আওয়ামী লীগ করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ভারতের বনগাঁ’র মুক্তিযোদ্ধাদের লিয়াজোঁ অফিসে অফিসিয়াল কাগজ পত্র লেখার কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৭১ এর মার্চের শেষ সপ্তাহে বাবা ভারতে চলে যান। এরপর রাজাকাররা প্রতিনিয়ত রাতের বেলায় আমাদের বাড়িতে গিয়ে উৎপাত করত। এ সময় আমি ও আমার বোন তাদের ভয়ে পাশের বাড়িতে ধানের ডোল মুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকতাম।
এভাবে সাতদিন ধরে লুকিয়ে থাকার পর ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের শেলের আঘাতে আমাদের গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তখন বাড়ি ফেলে পরিবারসহ শরণার্থীদের সাথে চলে যায় ভারতে। ভারতে প্রথম গিয়ে উঠি বেনাপোলের ওপারে জয়ন্তীপুরে।
তারপর আশ্রয় হয় বনগাঁ ক্যাম্পে। বাবা-মা, দাদির নিষেধ উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের লিয়াজোঁ অফিসে যায়। উদ্দেশ্য থাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। এই সময় বনগাঁয় মুক্তিযুদ্ধের লিয়াজোঁ অফিসের অফিস সহকারীর আশরাফ আলীর সহায়তায় তবিবুর রহমানের কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে আমি গোবরা ক্যাম্পে যায়।
আমার সাথে ছিলেন নাজমা খাতুন, মাজেদা বেগম, কানিজ বেগম ও ফাতেমা বেগম। সেখানে আমাদেরকে রাইফেল ও গ্রেনেড চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ চলে টানা ২০ দিন ধরে।
সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করে আমি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার নজরুল ইসলামের কাছে আরও প্রশিক্ষণ গ্রহন করি। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের আহত হওয়ার সংখ্যা এত পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে থাকে যে রোগী সামলাতে সবাইকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তখন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নারী যোদ্ধাদের নার্স হিসেবে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আগরতলা অস্থায়ী হাসপাতালে। শুধু আমি নয় আমার সাথে আরও প্রায় ১৫ জনকে পাঠানো হয় আগরতলার ওই অস্থায়ী হাসপাতালে।
তখন আমি ডাক্তার সেতারা বেগমের তত্ত¡াবধানে কাজ করতাম। আগরতলা পৌঁছে আমাকে আবার পুনরায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তবে এবার আমার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় নার্সিং বিষয়ে।
আমার প্রশিক্ষণ শেষ করে আমি আহত যোদ্ধাদের সুস্থ করার জন্য কাজ করতে শুরু করি। আম্বিয়া শফি আরও বলেছিলেন, তাঁর অস্ত্র প্রশিক্ষণ হয় গোবরা ক্যাম্পে আর নার্সিং ট্রেনিং হয় কলকাতার নীলরতন হাসপাতালে।
নীলরতনের প্রশিক্ষণের পর নেয়া হয় আগরতলা ক্যাম্পে। আম্বিয়া শফি নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবেন এই মনে করে যে তাঁর স্বামীও একজন মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি বলেন, যুদ্ধের ময়দানে আমার স্বামী এক হাতে যেমন বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করেছেন, ঠিক তেমনি অন্য হাতে ক্যামেরাও রেখেছেন। সেই প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শফির সহধর্মিণী আমি।
লেখক: সাজেদ রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক, যশোর।